ছুটি বাতিল হলেও ক্লাসে ফিরছেন না শিক্ষকরা
মুখোমুখি অবস্থানে সরকার ও শিক্ষক সংগঠন
প্রথম নিউজ,ঢাকা: গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করা হলেও দাবি আদায় না হওয়ায় ক্লাসে ফিরছেন না শিক্ষকরা। মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে কথাও বলতে চান তারা। অন্যথায় ক্লাসে না ফিরে বরং আন্দোলনে অনড় থাকার বিষয়ে নিজেদের অবস্থানের কথা জানিয়েছেন শিক্ষক নেতৃবৃন্দ। এ দিকে ঢাকায় এসে আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয়ে পরে অসুস্থ অবস্থায় নোয়াখালীর এক শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনায় ফুঁসে উঠছেন আন্দোলনকারীরা। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দও দাবি আদায়ের আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে মাঠে নামছেন বলে জানা গেছে।
আন্দোলনরত শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গ্রীষ্মকালের নির্ধারিত ছুটি বাতিল করার পেছনে মূলত আমাদের আন্দোলনের গতিকে শ্লথ করার একটা কৌশল সরকার নিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু শিক্ষকরা ছুটি বাতিলের এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ। তারা বলছেন, কোনো কৌশলেই জাতীয়করণের দাবিকে সরকার অগ্রাহ্য করতে পারে না। আর এটা শুধু শিক্ষকদের একার দাবি নয় বরং এই দাবি বাস্তবায়ন হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেরও অনেক সুবিধা হবে। এই দাবির যৌক্তিকতাও ইতোমধ্যে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে তুলে ধরেছি।
এ দিকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার এক শিক্ষক আন্দোলনে অংশ নিতে ঢাকায় এসে গত ১৭ জুলাই প্রেস ক্লাবের সামনে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন। পরে অসুস্থ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু তার ব্লাড প্রেসার ছিল উচ্চ মাত্রায়। পরে এই শিক্ষকের শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় তাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরে গত শুক্রবার রাতে তিনি মারা যান। এই শিক্ষকের নাম অহিদ আহম্মদ। তিনি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের এ কে জি ছায়েদুল হক আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক।
গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিলকে শিক্ষকদের আন্দোলন থামানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন আন্দোলনরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক নেতা। শিক্ষকদের দাবি, সরকারের এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তই ছিল না। থাকলে অবশ্যই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগেই থেকেই জানানো হতো। শিক্ষকরা বলেন, আন্দোলন থামানোর জন্য প্রথমে অনুপস্থিত শিক্ষকদের তালিকা করার নির্দেশ দেয়া হয়। এতে কাজ না হওয়ায় শেষ মুহূর্তে ছুটি বাতিল করে শিক্ষকদের আন্দোলন থামানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক কাওছার আহমেদ গতকাল সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকার যে উদ্দেশ্য বা কৌশলেই ছুটি বাতিল করুক না কেন দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো শিক্ষকই ক্লাসরুমে ফিরছি না। আমাদের দাবির বিষয় অনেক আগে থেকেই সরকারকে জানিয়ে আসছি। কিন্তু আমাদের দাবির বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। তাই ছুটি বাতিল করে কাল থেকে (আজ রোববার) স্কুল খুললেও আমরা ক্লাসে ফিরছি না।
অপর দিকে শিক্ষকদের ক্লাসে ফেরার অনুরোধ জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, জাতীয়করণের দাবি দাওয়া নিয়ে দু’টি কমিটি গঠন করার বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেছেন, জাতীয়করণের এই প্রক্রিয়া তিনি এগিয়ে নিতে সরকারের সাথে কাজ করবেন।
উল্লেখ্য, বেতনবৈষম্য দূর করাসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরেই রাজপথে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষকরা। স্কুলে স্কুলে তালা ঝুলিয়ে রাজধানীতে এসে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন তারা। বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি নিয়ে শিক্ষকদের ১০টি সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারের কাছে তাদের দাবি জানিয়েছে।
আন্দোলনরত শিক্ষকরা জানান, বিগত ১২ দিন ধরে তারা তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে রাজধানীতে এসে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। কিন্তু সরকারের কক্ষ থেকে দাবি মেনে নেয়ার বিষয়ে কোনো ভ্রƒক্ষেপই করা হচ্ছে না। পরে বাধ্য হয়েই গত রোববার সকাল থেকে ক্লাসরুমে তালা ঝুলিয়ে কয়েক হাজার শিক্ষক রাজপথে নেমে আসেন। এ সময় প্রেস ক্লাব ও আশপাশের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অধ্যবদি শিক্ষকরা প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
মাধ্যমিক শিক্ষা সরকারিকরণের দাবিতে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষকরা। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) ব্যানারে শিক্ষকরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করলেও আন্দোলেন সমর্থন দিয়েছেন অন্তত আরো ১০টি সংগঠন। এসব সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বাশিস), বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (প্রিন্স), বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন, বেসরকারি শিক্ষক ফোরাম (সাইদুল), বেসরকারি শিক্ষক ফোরাম (মাইনুদ্দিন), ভোকেশনাল শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ প্রধান শিক্ষক পরিষদ এবং জাতীয়করণ প্রত্যাশী মহাজোটসহ আরো কয়েকটি সংগঠন।
শিক্ষকদের দাবি দাওয়া বিষয়ে নেতৃবৃন্দ জানান, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা মাত্র ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা, ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। একই কারিকুলামে একই সিলেবাসে পাঠদান করিয়েও সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের থেকে একধাপ নিচে বেতন দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরে যাওয়ার পর অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। তাছাড়া বিগত কয়েক বছর ধরে অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট খাতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কেটে নেয়া হচ্ছে।
বর্তমানে সারা দেশে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ২০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৬৮৪টি, বাকিগুলো বেসরকারি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ১ লাখ ৯০ হাজার ২২। মোট শিক্ষক আছেন পৌনে তিন লাখের মতো। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অধিকাংশই এমপিওভুক্ত। এর মানে হলো এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে বেতনের মূল অংশসহ কিছু ভাতা পান। দীর্ঘ দিন ধরে এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা।