গ্রেপ্তার আতঙ্কে হাসপাতাল ছাড়ছেন রোগীরা
সংঘর্ষে হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ আহতদের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছেন সাদা পোশাকে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় আহতরা রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সংঘর্ষে হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ আহতদের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছেন সাদা পোশাকে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কেন সংঘর্ষে গেছেন? এমন অনেক প্রশ্ন করা হচ্ছে আহতদের। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে আহত রোগী ও তাদের স্বজনরা। এমনিতেই আহত, তার মধ্যে আবার আইশৃঙ্খলা বাহিনীর জেরা, তৎপরতা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেকেই চিকিৎসা শেষ না করেই হাসপাতাল ছাড়ছেন। তবে পুলিশ বলছে আতঙ্কের কিছু নেই।
আজ সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতাল) ঘুরে চিকিৎসক, নার্স, রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে গুরুতর আহতদের বেশীরভাগই রাজধানীর অন্যতম প্রধান এই ৪ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসাধীন রোগীরা চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখেই গ্রেপ্তারের ভয় ও আইনি জটিলতা এড়াতে গোপনে হাসপাতাল ছাড়ছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘বৈষম্যে বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ তিন সমন্বয়ককে গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা হেফাজতে নেওয়ার ঘটনা থেকেই মূলত গ্রেপ্তার আতঙ্ক শুরু হয়। তাই আহতরা পুরোপুরি সুস্থ না হয়ে অনেকেই হাসপাতালে ছাড়ছেন। অনেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েও চলে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আন্দোলনের শুরু থেকে হাসপাতালে ভর্তি আহত রোগীদের ওপর নজরদারি চালায় পুলিশ। কিন্তু দিনে দিনে এই নজরদারি বাড়ছে। এখন পর্যন্ত সমন্বয়ককদের বাইরে কাউকে হাসপাতাল থেকে আটক করা না হলেও ভবিষ্যতে আইনি জটিলতায় পড়ার শঙ্কা কাজ করছে রোগী ও তাদের স্বজনদের।
সরেজমিনে ঢামেক এলাকায় দেখা গেছে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেট থেকে ঢুকতেই ৫-৬ জন সাদা পোশাক পরিহিত পুলিশ বসে আছে। এর পরে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেছে হাসপাতাল গেটে রোগীর জটলা। সেখানেও অনেকে সাদা পোশাকে আহত রোগীদের নাম জানতে চাচ্ছেন। জেলা শহর থেকে গুলিবিদ্ধ আহত যে রোগী ঢামেকে আসছে তাদেরও নেওয়া হচ্ছে নাম-পরিচয়। গুলিবিদ্ধ আহত এক রোগীর বিষয় জানতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্য বলে উঠেন আপনি কে? পরিচয় দেওয়ার পর তিনি তার পকেট থেকে কার্ড বের করে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা। এভাবে জরুরি বিভাগে সাদা পোশাকে অবস্থানরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দেখা হয়। গুলিবিদ্ধ আহত রোগীদের দেখতে ঢামেকের জরুরি বিভাগের বার্ন ইউনিটে গেলে সেখানে অনেক আইশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের দেখা যায়। হাসপাতালের অনেক স্টাফও তাদের ভয়ে কথা বলতে রাজি নয়। রোগীদের সঙ্গে কথা বলতে ও ছবি তুলতে গেলে হাপাতালের স্টাফরা নিষেধ করেছেন। আবার আহত রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারাও আতঙ্কে থাকেন। অনেকে বলছে, ‘ভাই আর কত নাম—পরিচয় জানবেন। কপালে ছিল তাই এমন হয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢামেকর এক স্টাফ বলেন, সহিংসতায় আহতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিকিৎসা নিয়েছে ঢামেকে। এই হাসপাতালে গত ১৫ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত আট দিনে এক হাজার ৫৬০ জন চিকিৎসার জন্য এসেছে। এর মধ্যে গুরতর অবস্থায় হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছে ৩৭১ জন। অনেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে গেছেন। গুলিবিদ্ধ ভর্তি রোগীদের অনেক পরিবার তাদের নিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসাধীন হাসান নামে এক আহতের সঙ্গে কথা হয় দেশ রূপান্তরের। হাসান বলেন, কে কোন এলাকায় আহত হয়েছেন, রোগীদের এমন তথ্য নেওয়া হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তবে কি কারণে নেওয়া হয়েছে, তা জানি না। এ নিয়ে অনেক ভয়ে আছি। আহত বেসরকারি কলেজের এক শিক্ষার্থী সিয়াম জানান, তার দুই পা গুলিবিদ্ধ হয়ছে ঢাকা কলেজ এলাকায়। তার কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলে তারা স্বজনরা আতঙ্ক হয়ে পড়েন। তার মামা মতিউর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাবা আমার ভাগ্নে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাকে চিকিৎসার জন্য এখানে নিয়ে আসছি। আপনারা যদি কিছুক্ষণ পর পর আসেন তাহলে আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।’ পরে সাংবাদিক পরিচয় দিলে তিনি কথা বলেন। তখন তিনি জানান, অনেক এসে নাম—পরিচয় জানতে চেয়েছে। আর ও যেহেতু ছাত্র তাই সিয়ামের কাছে অনেকে এসে জেরা করছে।
এ বিষয়ে ঢামেক হাসপাতাল ক্যাম্পের পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় অনেক আহত রোগী আসছে। তাদের অনেকে সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জেরা বা তথ্য সংগ্রহর বিষয়টি মিথ্যা। অনেক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ঢামেকে কাজ করেন এটা সত্যি। তবে ঢামেকে রোগীদের আতঙ্কের কিছু নেই। এদিকে আহতদের মধ্যে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছে তিন সমন্বয়ককে গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল থেকে তুলে এনে ডিবি হেফাজতে রাখা নিয়ে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সমন্বয়কারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সোমবার দুপুর ১২টার দিকে পঙ্গু হাসপাতালের প্রধান ফটকে কথা হয় এক রোগীর স্বজনের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই রোগীর স্বজন জানান, আমার রোগী পায়ে গুলিবিদ্ধ হয় রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকায়। ২১ জুলাই থেকে তার চিকিৎসা এই হাসপাতালে চলছে। রবিবার সন্ধ্যার পর সাদা পোশাকে ৬-৭ জন সদস্য হাসপাতালে আসেন। তারা রোগীদের ভিডিও করে নিয়ে যান। এরপর থেকে আমরা যারা রোগী নিয়ে ভর্তি আছি তারা ভয়ের মধ্যে আছি। একতো হাসপাতালের যন্ত্রণা এরমধ্যে পুলিশি যন্ত্রণা শুরু হলে হাসপাতাল থেকে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
জরুরি বিভাগের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড-২-এ গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এক রোগীর স্বজনরা। জানতে চাইলে তারা বলেন, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার আনাগোনা বেড়েছে হাসপাতালে। এখন যদি পুলিশ পরিচয় নিয়ে রাখে তাহলে যেকোনো সময় আইনি ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। তাই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র না নিয়েই চলে যাচ্ছি।
পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, আমাদের হাসপাতালে পুলিশ কিংবা বাইরের যে কেউ প্রবেশ করতে হলে আমাদের অনুমতি নিতে হয়। এখন পর্যন্ত আমার কাছে প্রশাসন থেকে এরকম কোনো অনুমতি চাওয়া হয়নি। তাছাড়া হাসপাতালে যারা ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেই রোগী বা তাদের স্বজনরাও পুলিশি হয়রানির কোনো অভিযোগ জানাননি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আহত রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৫-৭ জনের একটি দল এসে ভিডিও করে নিয়ে গেছে। পরে শুনেছি তারা নাকি ডিবির লোক। আমরা তো আন্দোলনে যাইনি, রাস্তায় কাজ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছি। হাসপাতালে কেন পুলিশ আসবে? আমরা রোগীরা ভয়ে আছি।
একাধিক চিকিৎসক ও নার্স নিশ্চিত করেন গতকাল রবিবার রাত ও আজ সোমবার সকালে সাদা পোশাকে পুলিশের কয়েকজন সদস্য এসে হাসপাতাল ঘুরে গেছেন। তবে তারা রোগীদের ভিডিও করে নিলেও কাউকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, বিভিন্ন সময় পুলিশের পক্ষ থেকে রোগীদের তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু মানবিক দিক বিবেচনা করে রোগীদের নিরাপত্তার জন্য হাসপাতাল থেকে তথ্য দেওয়া হয়নি। শুরু থেকেই অনেক রোগী পুলিশি হয়রানির ভয়ে নিজের নাম গোপন করে চিকিৎসা নিয়েছেন আমরা বুঝেও ছাড় দিয়েছি।
এদিকে চক্ষু হাসপাতাল সোমবার মাত্র ১০ জনের মতো রোগী ভর্তি পাওয়া গেছে। ১৭ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ৫ শতাধিক রোগী এই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিলেও পুলিশ আতঙ্কে বাকি রোগীরা হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা বলেন, পুলিশি হয়রানির কোনো অভিযোগ নেই। যাদের চিকিৎসা শেষ হয়েছে তারা বাড়ি চলে গেছেন। পুলিশ হাসপাতালে আসেনি। আমাদের রোগীদের যে ধরনের ইঞ্জুরি তাতে বেশিদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার প্রয়োজন নেই। সূত্র: দেশ রূপান্তর