কোমরসমান পানির নিচে সোনালি ধান, শ্রমিক সংকটে কৃষকের আনন্দ ম্লান

বোরোর ফলন ভালো হলেও লোকসানের চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়েছে কৃষকদের। চলতি মাসের শুরু থেকে দফায় দফায় ঝড়-বৃষ্টিতে জেলার নিম্নাঞ্চলের ধানখেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে শ্রমিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

কোমরসমান পানির নিচে সোনালি ধান, শ্রমিক সংকটে কৃষকের আনন্দ ম্লান

প্রথম নিউজ, নীলফামারী: নীলফামারীর ছয় উপজেলায় বোরো ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। বোরোর ফলন ভালো হলেও লোকসানের চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়েছে কৃষকদের। চলতি মাসের শুরু থেকে দফায় দফায় ঝড়-বৃষ্টিতে জেলার নিম্নাঞ্চলের ধানখেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে শ্রমিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

জানা গেছে, বর্তমান বাজারে প্রতি মণ ধান ৮৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচই উঠছে না কৃষকদের। সেই সঙ্গে ধানক্ষেত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এতে অনেকে বাধ্য হয়ে পরিবারের লোকজন নিয়ে ধান কাটছেন।

সরেজমিনে জেলা সদর, ডোমার, ডিমলা, কিশোরগঞ্জ ও সৈয়দপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ফসলের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক দফা কালবৈশাখী ঝড়ে হেলে পড়া ধানসহ নিচু জমির ৯০ শতাংশ ধান পেকে পানিতে তলিয়ে গেছে। ধান পাকলেও শ্রমিক সংকটের কারণে বেশির ভাগ জমির ধান এখনো কাটতে পারেননি কৃষকরা।

নীলফামারী সদর উপজেলার ইটাখোলা ইউনিয়নের পাঁচমাথা এলাকার রশিদুল ইসলাম এবার দশ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, চারা রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, কীটনাশক, সেচ, কর্তন, পরিবহন, মাড়াইসহ বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকারও বেশি। প্রতি বিঘায় ২০-২২ মণ ধান হবে। এখন বাজারে এক মণ ধান ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সে হিসেবে কোনো লাভ হচ্ছে না।

একই এলাকায় লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের কাচারী বাজার এলাকার কৃষক শরৎ রায় দুই বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছেন। বৃষ্টির পানিতে ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় ধান আগে ভাগেই কর্তন করে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। দুদিন পানিতে থাকলে ধান নেওয়া যাবে না। তাই আগেই ধান কেটে নিতে হচ্ছে। লাভের আশা আর নাই, খরচটা উঠলেই শান্তি।

একই অবস্থা চওড়া বড়গাছা ইউনিয়নের দক্ষিণ চওড়া গ্রামের কৃষক সুমন ইসলামের। তিনি আবাদ করেছেন ২০ বিঘা জমিতে। তিনি বলেন, ধান ডুবে রয়েছে হাঁটু পানিতে। শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এই এলাকার শ্রমিকরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ধান কাটতে যায়। যার কারণে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়।

দক্ষিণ কানিয়াল খাতা গ্রামে গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে পানিতে নেমে ধান কর্তন করছেন ছয়জন। দেড় বিঘা জমির ধান কর্তন করতে চুক্তি নিয়েছেন ছয় হাজার টাকা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, শ্রমিক নেই এলাকায়। টাঙ্গাইল, নওগাঁ, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটতে গেছে। ওইসব এলাকায় বেশি মজুরি পাওয়া যায়।

ডিমলা উপজেলার খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের কৃষক প্রিন্স বলেন, ৭ বিঘা জমিতে বোরো ধান রোপণ করেছি। ধান ক্ষেতে হাঁটু পরিমাণ পানি। ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এমনিতেই শ্রমিক সংকট আবার ধান ক্ষেতে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। এজন্য বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। তবুও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।

কিশোরগঞ্জ উপজেলার কৃষক আলেনূর রহমান বলেন, প্রতি বিঘা জমির (৬০ শতাংশ) ধান কাটতে সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা শ্রমিকদের দিতে হচ্ছে। দুপুরের খাবারে দিতে হচ্ছে পাউরুটি, কলা। আর মেশিনে ধান মাড়াইয়ের জন্য দিতে হচ্ছে বিঘা প্রতি ৮০০ টাকা। এত কিছুর পরও এলাকায় শ্রমিক মিলছে না। ধানকাটা শ্রমিক সর্দার জয়নালের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমার দলে মোট ১০ জন শ্রমিক আছেন। এনজিওর কিস্তি ও সংসারের অভাব-অনটনের কারণে প্রতি বিঘা ধান কাটার জন্য সাড়ে ৫ হাজার করে টাকা নেওয়া হয়েছে। আমরা শুধু ধান কেটে কৃষকের উঠানে পৌঁছে দেব।

সদরের ঢেলাপীর হাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৮০০-৮৫০ টাকা দরে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকাররা ধান কিনে বস্তাবন্দি করছেন। পরে ট্রাকে সেগুলো মিলারদের কাছে একটু বেশি দামে বিক্রি করছেন।

জেলা সদরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রাকিব আবেদীন হিরু বলেন, ঝড় বৃষ্টির পূর্বাভাস আমরা আগেই পেয়েছিলাম। সে রকম তথ্য আমরা কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছি। যেসব ক্ষেতের ধান ৮০ ভাগ কাটার উপযুক্ত হয়েছে সেগুলো কর্তনের পরামর্শ দিয়েছি। বৃষ্টির কারণে কোনো কোনো এলাকায় ধান কাটা শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা কৃষকদের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য উদ্বুদ্ধ করছি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, এ বছর নীলফামারীর ছয় উপজেলায় ৮২ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ২৬৪ মেট্রিক টন ধান।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom