এসআইসহ ২ পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ
অভিযোগ উঠেছে আশুলিয়া থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) নোমান সিদ্দিকী ও সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) বদরুল হুদার বিরুদ্ধে।
প্রথম নিউজ, সাভার: প্রথমে সন্দেহজনক আটক করে সাদা প্রাইভেটকারে তুলে নিয়ে মাদক দিয়ে আদালতে পাঠানোর ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এমনি বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে আশুলিয়া থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) নোমান সিদ্দিকী ও সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) বদরুল হুদার বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয় সন্দেহজনকদের শারীরিক নির্যাতন করে টাকা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকার নাজমুল হোসেন মোল্লাকে সন্দেহজনকভাবে ধরে ৭৪ হাজার, ভাদাইল এলাকার আলমগীর হোসেনের কাছ থেকে ৩০ হাজার ও আরিফ খান নামের এক ব্যক্তিকে ধরে ৮২ হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দেন এসআই নোমান সিদ্দিকী ও এএসআই বদরুল হুদা। এমনকি আরিফ খানের সদ্য এইচএসসি পাস করা মেয়েকে কুপ্রস্তাব দেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে। এছাড়া শিশু সন্তানের সামনেই তার বাবাকে বেধরক পিটিয়েছেন তারা। অবশেষে টাকা পেয়ে আরিফ খানকে ছেড়ে দেন। ভুক্তভোগী তিনজনের দুজন মাদকসেবী ও আলমগীরের বিরুদ্ধে ময়লা ব্যবসার দ্বন্দ্বে মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
ভুক্তভোগী নাজমুল হোসেন মোল্লা বলেন, গত ১১ জুলাই বিকেলে আমি কাঠগড়া পশ্চিমপাড়া আমাদের ভাড়া বাড়ির পাশে মাচায় বসে নির্মাণ শ্রমিকের অপেক্ষা করছিলাম। তারা আমার বাড়ির কাজ করেছে তাই তাদের বিল পরিশোধ করার জন্য পকেটে ২৪ হাজার টাকা নিয়ে বসে ছিলাম। কিন্তু বিকেলে আশুলিয়া থানা পুলিশের এসআই নোমান সিদ্দিকী ও এএসআই বদরুল হুদাসহ তিনজন এসে পশ্চিম কাঠগড়া এলাকা থেকে আমাকে প্রাইভেটকারে তুলে নেয়। এ সময় আমার পকেটে থাকা ২৪ হাজার টাকা নিয়ে নেন তারা। পরবর্তীতে আরও টাকা আনার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। টাকা আনতে সময় লাগায় নির্যাতন শুরু করে। প্রায় ৪/৫ ঘণ্টা নির্যাতন করলে আরও ৫০ হাজার টাকা আমার শ্যালকের মাধ্যমে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেইটে তাদের দিয়ে ছাড়া পাই। টাকা না দিলে তারা মাদক দিয়ে মামলা দেওয়ার হুমকি দেয়। টাকা নেওয়ার পর ঘটনা কাউকে জানালে আবারও মাদক দিয়ে মামলা দেওয়ার ভয় দেখায় পুলিশ। এএসআই বদরুল আমার পায়ের তালুতে পিটিয়ে টাকা আনতে বাধ্য করেছে। আর এসআই নোমান সিদ্দিকী ভয়ভীতি দেখিয়েছেন।
নাজমুল হোসেনের ভাই আসাদ বলেন, আমার ভাইকে এসআই নোমান ও এএসআই বদরুল নির্যাতন করে ৭৪ হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তারা পায়ের তালুতে পিটিয়েছে। আমি শতভাগ নিশ্চিত হয়েই আপনাদের বলছি যে এসআই নোমান ও এএসআই বদরুল আমার ভাইকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে। তিনি আরও বলেন, আমাকে আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (অপারেশন) জামাল শিকদার ১৫ জুলাই দেখা করতে বলেছেন। দেখা করার পর তিনি কি বলেন আপনাদের জানাব। ১৫ জুলাই বিকেলে নাজমুলের ভাই আসাদ মোবাইল ফোনে বলেন, আমাকে থানার অপারেশন ওসি জামাল শিকদার ডেকে নেন। তার সামনে এসআই নোমান সিদ্দিকী ও এএসআই বদরুল হুদা ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন। আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনাদের কিছু করার দরকার নেই।
ভাদাইল এলাকার সুইপার আরিফ খান বলেন, সেদিন ছিল ২৮ মে আইপিএল এর ফাইনাল খেলার দিন। ভাদাইলের কাঠালতলা এলাকায় আমি ভাড়া বাসার নিচের দোকানে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলাম। এসময় হঠাৎ করে পিছন দিয়ে এসে এএসআই বদরুল হুদা ও তাদের সোর্স রোমান আমাকে ঝাপটে ধরে হ্যান্ডকাফ পরায়। পরে আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে তল্লাশি করে ১০০ গ্রাম গাঁজা পায়। আমি সুইপার মানুষ, আমি একটু গাঁজা খাই। এজন্য আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে প্রথমে আমার ১০ বছরের বাচ্চা মেয়ের সামনে আমাকে নির্যাতন শুরু করে। আমার ঘরে তালা দেওয়া ছিল। তারা পাশের কক্ষ থেকে হাতুরি নিয়ে এসে তালা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে। সেখানেই প্রায় ১ ঘণ্টা নির্যাতন করে। পরে বিছানার নিচে রাখা ৩২ হাজার টাকা নিয়ে পকেটে ঢুকায় বদরুল। আমার ওপর নির্যাতন করলে আমার বাচ্চা মেয়েটা কান্নাকাটি করে। তখন এসআই নোমান সিদ্দিকী মেয়েকে বলে চিৎকার চেচামেচি করলে তোমার আব্বুকে আমরা নিয়ে চালান করে দেব। চুপ করে থাকলে ছেড়ে দেব।
পরে আমার বড় মেয়ে এলে তাকে ১ লাখ টাকা সংগ্রহ করে দিতে বলে এসআই নোমান সিদ্দিকী। মেয়ে টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এএসআই বদরুল। বদরুল বলে, আমার মেয়েকে সারারাত গাড়িতে করে ঘুরে নিয়ে বেড়াবে। আমার মেয়েকে তাদের হাতে তুলে দিলে একটি টাকাও লাগবে না। আমাকে ভাদাইলের কিং বানিয়ে দেবে। তিনি আমার মেয়েকেও আমার সামনে এমন কুপ্রস্তাব দেন। এসময় পাশে থেকে এসআই নোমান সিদ্দিকী মুচকি মুচকি হাসেন। পরে বাসা থেকে আমাকে প্রাইভেটকারে তুলে নিয়ে কাশিমপুরের সারদাগঞ্জের কুয়েরি টেক্সটাইলের পাশে নিয়ে যায়। আমি বলেছি আমার কাছে ১০০ গ্রাম গাঁজা পেয়েছেন, আমি অপরাধী, আমাকে চালান করে দেন। কিন্তু তারা আদালতে না পাঠিয়ে টাকা দাবি করেন।
আমি সুইপার আর আমার স্ত্রী মানুষের বাসায় কাজ করে। আমরা টাকা কোথায় পাবো তাদের এভাবে বললে আমার ফোন দিয়ে আমার মেয়েকে লাইনে রেখে আমার ওপর নির্যাতন চালায়। প্ল্যায়ার্স দিয়ে আমার নখে চাপ দিয়ে নির্যাতন করলে আমি চিৎকার করি। নিরুপায় হয়ে আমার বড় মেয়ে করোনার সময় স্কুল বন্ধ অবস্থায় চাকরি করে জমানো টাকা দিতে রাজি হয়। পরে স্থানীয় জয় ফোন ফ্যাক্সের দোকানে ৫০ হাজার টাকা আনায়। সেই টাকা তুলে এসআই নোমান ও এএসআই বদরুলকে দিলে আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি এখনও আতঙ্কে রয়েছি। জয় ফোন ফ্যাক্সের দোকান মালিক বলেন, আমার বিকাশের দোকানের মাধ্যমে টাকা তারা দুটি মোবাইল নম্বরে এনেছিল গত ২৮ মে। এই টাকা কি করেছে এসব আমি জানি না।
ভুক্তভোগী আরিফের মেয়ে বলেন, এসআই নোমান ও এএসআই বদরুল হুদা দূরে আমার বাবাকে নিয়ে গাড়িতে ছিল। আমি টাকা তুলে নিয়ে তাদের কাছাকাছি যাই এবং আমার মাকে টাকাটা দিয়ে আসতে বলি। এর আগে আমি আমার বাবাকে দেখতে চাই। তারা আমার বাবাকে দেখিয়ে আমার হাত থেকেই টাকা নেবে বলে জানায়। আমাকে গাড়ির কাছে একাই টাকা নিয়ে ডাকে তারা। আমি ভয় পেয়েছিলাম। তাই আমি আমার মায়ের সাথে গিয়েই টাকাটা দিয়ে বাবাকে নিয়ে আসি। অপর ভুক্তভোগী আলমগীর হোসেন বলেন, গত ৪ ফেব্রুয়ারি আমাকে ফোন করেন নোমান সিদ্দিকী। তিনি থানায় দেখা করতে বলেন। কিন্তু আমি থানায় গেলেও তার সঙ্গে দেখা না করে চলে আসি। পরবর্তীতে তিনি আমাকে চার্জশিটে নাম ঢুকিয়ে চালান দেওয়ার হুমকি দিয়ে ১ লাখ টাকা দাবি করেন। পরে অনেক কষ্টে ৩০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে তাকে দিয়ে দেই। কিন্তু এখনও আমাকে নানাভাবে হয়রানি করে যাচ্ছে। তিনি আমার কাছে কাজ চান। আমি তো সোর্স না যে তাকে কাজ দিতে পারবো।
এই ঈদের আগে আমার সঙ্গে দেখা হলে এসআই নোমান বলেন, ঈদ ভেতরে করবেন নাকি বাইরে। আমি বলেছি আমি বাইরে করব, জেলখানার ভেতরে ঈদ করবো কেন। তিনি বলেন, আপনাকে কেরানীগঞ্জ রেখে আসব যদি কাজ না দেন। এভাবেই এখনও হুমকি প্রদান করছেন তিনি। বিভিন্নভাবে তিনি বিরক্ত করেই চলেছেন। আমার কাছ থেকে নোমান সিদ্দিকী ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন। তার সঙ্গে আর কেউ ছিল কি না তা আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে অভিযুক্ত এসআই নোমান সিদ্দিকী বলেন, ভাদাইলের আলমগীরকে মামলা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, ভয়ভীতি দেখিয়েছি। কিন্তু টাকা নেওয়ার বিষয়টি মিথ্যা। আর ওই এলাকা আমার বিট এলাকা। আগামীকাল আরিফ খানকে খুঁজে বের করব। কে এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা জানতে চাইবো।
বাকি ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করেছেন। তবে নাজমুল হোসেন মোল্লার বিষয়ে এক এএসআই ফোন করেছিল বলে তিনি স্বীকার করেছেন। তবে তার বক্তব্য নেওয়ার পরপরই নাজমুল হোসেন মোল্লার ভাই আসাদের কাছে তিনি লোক পাঠিয়ে বিষয়টি মিমাংসার চেষ্টা করেন বলে জানান আসাদ। অভিযুক্ত এএসআই বদরুল বলেন, এসব বিষয় আমি জানি না। আপনি নোমান স্যারের সাথে কথা বলেন।
আশুলিয়া থানা পুলিশের পরিদর্শক (অপারেশন) জামাল শিকদার তার সামনে মাফ চাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোমেনুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি শুনলাম। আমি তাদের ডেকে বিষয়টি শুনছি। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান (পিপিএম) বলেন, আমি তো জানি না। বিষয়টি দেখছি।