ইজারা ছাড়াই হরিলুটে চলছে ফরিদপুরের একমাত্র নৌবন্দর
সরেজমিনে সিঅ্যান্ডবি ঘাট এলাকা ঘুরে ও প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধান করে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রথম নিউজ, ফরিদপুর: চার বছর ধরে ইজারা ছাড়াই পরিচালনা করা হচ্ছে ফরিদপুরের সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দরটি। আর খাস কালেকশনের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা উত্তোলন করছে বিআইডব্লিউটিএ। যদিও ব্যবসার সঙ্গে বেড়েছে অর্থ আয়ের পরিমাণ, তবে এখনো একটি মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর সন্দেহের তীর উঠেছে বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট খাস কালেকশন সংগ্রহকারীদের বিরুদ্ধে। সরেজমিনে সিঅ্যান্ডবি ঘাট এলাকা ঘুরে ও প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধান করে এসব তথ্য জানা গেছে।
ফরিদপুর শহরের পূর্বাংশে পদ্মা নদীর পাড়ে সিঅ্যান্ডবি ঘাটটি ২০১৫ সালে তৃতীয় শ্রেণির নৌবন্দর হিসেবে ঘোষণা করে বিআইডব্লিউটিএ। আরিচা নদীবন্দরের অধীনে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো ও ট্রলারে সিমেন্ট, বালু, কয়লা, রডসহ অন্তত ৫০ ধরনের পণ্য আনা-নেওয়া করা হয় এ বন্দর দিয়ে। কুলি-শ্রমিকসহ প্রায় ৮ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান এখানে।
করোনাকাল শুরু হওয়ার আগে ২০১৯-২০ অর্থ বছর পর্যন্ত ঘাটটির ইজারাদার ছিল মেসার্স শান্ত এন্টারপ্রাইজ। ওই অর্থবছরে ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ ইজারার পরিমাণ ছিল প্রায় ৮০ লাখ টাকা। এর পরের বছর ডিক্রিরচর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মেহেদি হাসান মিন্টু ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় ঘাটটির ইজারা নেন। তবে সেসময়ে শান্ত এন্টারপ্রাইজের মালিক সিদ্দিকুর রহমান এনিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করলে মেহেদি হাসান মিন্টু ঘাটের ইজারা বুঝে নিতে পারেননি। এ অবস্থায় ওই অর্থবছর থেকে বিআইডব্লিউটিএ ইজারার পরিবর্তে খাস কালেকশনের মাধ্যমে নৌবন্দর থেকে খাজনা আদায় শুরু করে।
জানা গেছে, প্রতি দশদিন অন্তর ৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা কালেকশন করা হয় এই সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দর থেকে। নৌবন্দরে নিযুক্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে এই টাকা জমা করা হয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে। সে অনুযায়ী প্রতিবছর এই ঘাট থেকে ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ আয় হচ্ছে প্রায় ১ কোটি ৭৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই আয় ইজারাকালীন সময়ের আয়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। এতে সরকারের কোষাগারে আগের চেয়ে বেশি টাকা জমা হচ্ছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র মতে, সিঅ্যান্ডবি ঘাটের এই খাস কালেকশনের মাধ্যমে আয় হওয়া টাকার পরিমাণ আরও বেশি। যা এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে পকেটস্থ করছে। তাছাড়া বছরের ৬ মাস ঘাটটিতে পণ্য আনা-নেওয়া সচল থাকে। শুকনো মৌসুমের চেয়ে বর্ষা মৌসুমে আয় হয় বেশি। কিন্তু সারাবছর একই পরিমাণ খাস কালেকশনের বিষয়টিও স্বাভাবিক নয়। ইতোপূর্বে ঘাটের খাস কালেকশন সংগ্রহে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগও ওঠে।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ ১০ দিনে সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দর থেকে ৮ লাখ ৪৫ হাজার ৮০০ টাকা আয় হয়। কিন্তু সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে মাত্র মাত্র ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮৩৭ টাকা। বাকি টাকা আত্মসাৎ করে একটি চক্র। বর্তমানে প্রতিমাসে গড় হিসাবে ৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমা করা হচ্ছে।
সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দরের খাস কালেকশনে নিযুক্ত বিআইডব্লিউটিএর কর্মচারী মোনায়েম বসুনিয়ার বিরুদ্ধে এর আগে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। তার বিরুদ্ধে টাকা ও সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগও রয়েছে। সূত্র মতে, প্রতিবছর খাস কালেকশনের জমাকৃত টাকার চেয়ে প্রায় কোটি টাকার বেশি আদায় হয় এই ঘাট থেকে। যা বিভিন্ন মহল ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিব্লিইটিএ) মোনায়েম বসুনিয়াসহ এই আত্মসাৎ চক্রে তার কয়েকজন সহযোগীও রয়েছেন।
২১ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ১০ দিনে আরিচা নদীবন্দরের অধীন ফরিদপুর সিঅ্যান্ডবি ঘাট থেকে শুল্ক আদায় হয়েছে ৮ লাখ ৪৫ হাজার ৮০০ টাকা, কিন্তু মোনায়েম বসুনিয়া সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছেন মাত্র ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮৩৭ টাকা। বাকি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এভাবে নিয়মিতই তিনি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৮ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে মোনায়েম বসুনিয়াসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়েছিল। মামলাটি বিআইডব্লিউটিএর সেলে বিচারাধীন ছিল।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) আরিচা নদীবন্দরের শুল্ক আদায়কারী মো. মোনায়েম বসুনিয়া বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। এখানে অনিয়ম দুর্নীতি অবৈধ কিছু করার সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, এই সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দর থেকে প্রতি দশদিন অন্তর ৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা কালেকশন করা হয়। এই টাকা জমা করা হয় সংশ্লিষ্ট সরকারি ব্যাংক হিসাবে। এখানে কম টাকা জমা দেওয়া এবং রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিবছর এই ঘাট থেকে ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ আয় হচ্ছে প্রায় ১ কোটি ৭৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।
১৮ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে মোনায়েম বসুনিয়াসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, এতে আমি একা ছিলাম না। মামলায় আরও কয়েকজন ছিলেন। তবে তা মিটে গেছে। কোনো সমস্যা নেই।
এ বিষয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, এ বিষয়ে তেমন কিছুই জানা নেই। ফরিদপুরের সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দরটি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এ বিষয়ে ভালো এবং বিস্তারিত বলতে পারবে।