Ad0111

আ’লীগের তৃণমূলে বাড়ছে বিভাজন: দুশ্চিন্তা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে

গত পাঁচ ধাপের নির্বাচনী সংঘাতে শতাধিক প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছেন হাজারের বেশি নেতাকর্মী। দলীয় বিভাজনের ফলে নৌকার চেয়ে বিরোধীদের জয়ের হার বাড়ছে। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদেরও।

আ’লীগের তৃণমূলে বাড়ছে বিভাজন: দুশ্চিন্তা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে
এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানেই আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মারামারি-সংঘর্ষ হয়েছে

প্রথম নিউজ, ঢাকা: ধাপে ধাপে সারাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে বাড়ছে বিভাজন। কোথাও কোথাও এ বিভাজন রূপ নিচ্ছে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে। গত পাঁচ ধাপের নির্বাচনী সংঘাতে শতাধিক প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছেন হাজারের বেশি নেতাকর্মী। দলীয় বিভাজনের ফলে নৌকার চেয়ে বিরোধীদের জয়ের হার বাড়ছে। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদেরও।

দলীয় সূত্র বলছে, এ নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। তারা নৌকার বিরোধিতাকারীদের তালিকা করছেন। নৌকার বিরোধিতায় কারা ইন্ধন দিচ্ছে, কার কী ভূমিকা—সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেবে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। জাতীয় নির্বাচনের আগেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে ঘর গোছাতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, এখনই রোগ নির্ণয় করে সারিয়ে তুলতে না পারলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত পাঁচ ধাপের ইউপি নির্বাচনের প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান পদে নৌকা জিতেছে ৭৬ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপে ৫৯ শতাংশ, তৃতীয় ধাপে ৫৪ শতাংশ এবং চতুর্থ ধাপে ৫১ শতাংশ। পঞ্চম ধাপে নৌকা জেতার হার আরও কমেছে। অবশিষ্টদের মধ্যে বেশিরভাগ বিদ্রোহী প্রার্থী জিতেছে। ফলাফলের চেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, ভোট দিতে পারেননি নৌকার প্রার্থী, জালভোট দিতে গিয়ে নৌকার প্রার্থী আটক, অবরুদ্ধ নৌকার প্রার্থী বা নৌকা প্রতীকে ৫৬ ভোট—এ জাতীয় সংবাদ শিরোনাম সামনে এসেছে।

নৌকা প্রতীকে ৫৬ ভোট!: পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ফরিদপুরের একটি ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী লজ্জাজনক হার হেরেছেন। চেয়ারম্যান পদে ১১ জন প্রার্থীর মধ্যে তিনি পেয়েছেন মাত্র ৫৬ ভোট! আর এমন লজ্জাজনক হারে রেকর্ড গড়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্যাহর নির্বাচনী এলাকা সদরপুর উপজেলার চরমানাইর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মো. বজলু মাতুব্বর। শুধু তাই নয়, এ ইউনিয়নে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীও দুই শতাধিক ভোট পেয়েছেন। অথচ প্রতিটি ওয়ার্ড ও ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের কমিটিও আছে। এ ইউনিয়নে চশমা প্রতীক নিয়ে তিন হাজার ৩০০ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন মো. রফিকুল ইসলাম।

ভোট দিতে পারেননি নৌকার প্রার্থী!: যশোরের শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়নে নৌকা মার্কার প্রার্থী ইলিয়াস কবির বকুল ভোটের দিন রোববার (২৮ নভেম্বর) সকাল থেকে নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ ছিলেন। বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুল খালেকের সমর্থকরা অবরুদ্ধ করে রাখায় নিজের ভোটটিও দিতে পারেননি বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন ওই প্রার্থী। নৌকার প্রার্থী ইলিয়াছ কবির বকুল অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচনের আগের রাতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্যাডাররা আমাকে নানাভাবে হুমকি দিয়েছে। বিষয়টি আমি প্রশাসনকে জানিয়েছি। পুলিশ উল্টো আমার লোকজনকে মারপিট করেছে। আমি বাসা থেকে বের হতে পারিনি। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হয়েও নিজের ভোটটি পর্যন্ত দিতে পারিনি। স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল খালেক বিএনপি-জামায়াতের সহযোগিতায় ভোটকেন্দ্র দখল করে জাল ভোট প্রয়োগ করছেন। তাদের সহযোগিতা করেছে পুলিশ।

দায়িত্বশীল নেতারা যা বলছেন: ইউপি নির্বাচন ও তৃণমূলের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা ইউনিটের সহ-সভাপতি জাগো নিউজকে বলেন, এই প্রতীক দিয়ে তৃণমূল আওয়ামী লীগে বিভাজন বেড়েছে। প্রতীক তুলে দিলে বরং ভালো হতো। কারণ নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া যায় বা নৌকার বিরোধিতা করলে কিছুই হয় না, এই মেসেজটা তৃণমূলে যাচ্ছে। এটি খারাপ পরিণতির ইঙ্গিত করছে। এমনও নজির আছে, একটা ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন প্রার্থী। একজন নৌকার, বাকি চারজন এক হয়ে গেছেন নৌকাকে হারাতে।

ঢাকার পার্শ্ববর্তী এক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখনকার মনোনয়ন দেওয়া হয় টাকার বিনিময়ে বা স্বজনপ্রীতি করে। এ কারণে তুলনামূলক কম যোগ্য লোকের কাছে যাচ্ছে নৌকা। বিদ্রোহী বা তার চেয়ে যোগ্য লোক পাস করে যাচ্ছে, নৌকা হারছে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, নৌকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী-সমর্থকদের আবেগ-ভালোবাসার প্রতীক। আগে মনোনীত প্রার্থী পছন্দ না হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতার প্রবণতা ছিল না, এমন নয়। এবারের ইউপি নির্বাচনে এর প্রবণতা আশঙ্কাজনক। তিনি আরও বলেন, এখন সময় এসেছে আমাদের নিরপেক্ষ, নির্মোহ ও গভীরভাবে গবেষণা করতে হবে যে, অনেক ইউনিয়নে কেন নৌকার বিপক্ষে দলের তৃণমূল অবস্থান নিয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে তা প্রশমনের উদ্যোগ না নিলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে একজন মাঠকর্মী হিসেবে আমি মনে করি।

দলটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, বিষয়টি আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা দেখছি কোথাও কোথাও নির্বাচনে ভেতরে ভেতরে সরকারের বিরুদ্ধে অনেকেই কাজ করেছেন। এগুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। নৌকার প্রার্থী হারাতে পারলেই তারা আনন্দ পান, এরকম একটা বিষয়। নিরপেক্ষতা মানেই তারা মনে করেন নৌকাকে হারানো। তবে এ নিয়ে হতাশ নন আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী। তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন এক নয়। দুই নির্বাচনের প্যাটার্ন আলাদা। স্থানীয় নির্বাচনে গোষ্ঠীগত বিষয় ও আঞ্চলিকতা কাজ করে। খালের এপাড়-ওপাড়, এই পাড়া সেই পাড়াসহ নানান কারণে বিভাজন হয়। আশা করি জাতীয় নির্বাচনের আগেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। স্থানীয় নির্বাচনে বিভাজনের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে না।

একই রকম বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, আমাদের ভাবনা তো আছেই। ভাবনা থাকাটা, চিন্তা থাকাটা তো দোষের কিছু নয়। তবে নৌকায় ভোট দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা এমন নয়। কারণ নৌকা মার্কার প্রার্থী যেমন আওয়ামী লীগের, অন্য যারা দাঁড়িয়েছে- স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী যাই বলেন, তারাও তো আওয়ামী লীগের লোক। ভোটেও আমরা, ময়দানেও তো আমরাই। অতএব নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে এমন নয়। যেহেতু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে যাদের অংশগ্রহণ করা দরকার ছিল, তারা আসেনি। তাই এই পরিস্থিতি হয়েছে।

নাছিম বলেন, প্রতিপক্ষের সঙ্গে নির্বাচনী যুদ্ধে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা একাট্টা হয়েই নামেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আসল হাসিটা হাসবেন। এটা নিয়ে কোনো চিন্তা বা সংশয় নেই। যে সময়টা আছে, এর মধ্যে যেখানে যেখানে অনুরাগ-রাগ-ব্যথা-বেদনা-অভিমান আছে, সেটা আমরা দূর করে নিতে পারবো।

তবে ভিন্নমত দিয়েছেন আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সহ-সভাপতি কাদের খান। তিনি বলেন, তৃণমূলের এই নির্বাচনে যে বিভাজন হয়ে গেলো এর প্রভাব তো জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে। দেখা গেছে, নৌকার প্রতীক একজন পেয়েছে, বিদ্রোহী পাঁচজন ছিলেন। ওই পাঁচজন এক হয়ে নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করেছেন। এই কালচার তো জাতীয় নির্বাচনেও থাকবে। নৌকা প্রতীক নিয়ে যিনি ছিলেন, তিনি জাতীয় নির্বাচনে নৌকার পক্ষে গেলে, বিদ্রোহীরা তার বিরোধিতা করবে। তিনি বলেন, নীতি নির্ধারকরা বুঝুক ব্যাপারটা। কেন তারা নৌকা প্রতীক দিতে গেলেন? কোন হিসেবে তারা ইউনিয়ন পরিষদে নৌকা দেন? এটা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা কোনো অবস্থাতেই তৃণমূলে নৌকা দেওয়ার পক্ষে নই। নৌকা শুধু জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহার করা হোক।

কাদের খান বলেন, নৌকা দিলেও মনোনয়ন যদি সঠিকভাবে দেওয়া হতো, তাহলে এত বিদ্রোহী হতো না। বিদ্রোহী প্রার্থী কখন হয়? যখন একটা অযোগ্য লোক নৌকা পায়। তখন সব যোগ্য লোক এক হয়ে যায়। তখনই বিদ্রোহী প্রার্থী ছড়িয়ে যায়। আপনি মনোনয়ন দেবেন- যার যোগ্যতা নেই, হাইব্রিড, টাকাওয়ালা। তাহলে তো এই পরিস্থিতি দাঁড়াবেই। কারা টাকা খাচ্ছে, এমন প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, ‘টাকা খেয়ে এমপি সাহেবরা এগুলো করছেন।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

This site uses cookies. By continuing to browse the site you are agreeing to our use of cookies & privacy Policy from www.prothom.news