লুটপাটের তথ্য লুকাতে জ্বালানি নিয়ে গণশুনানি তুলে দেওয়া হয়েছে: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম
আজ বৃহস্পতিবার (২২ জুন) দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা: ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে প্রস্তাবিত পদক্ষেপ’ নিয়ে আলোচনায় এসব কথা বলেন তিনি।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেছেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) এখন আর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) যাওয়া লাগছে না। আইন পরিবর্তন করে বিপিসিকে ব্যবসায়ী বানানো হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (২২ জুন) দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা: ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে প্রস্তাবিত পদক্ষেপ’ নিয়ে আলোচনায় এসব কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন,‘ রাতারাতি আইন বদলে গেলো। দাম বাড়াতে বিপিসিকে আর বিইআরসিতে আসা লাগলো না। বিপিসি নিজেই ব্যবসায়ী, নিজেই ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণ করে। অর্থাৎ ব্যবসায়ী নিজেই তার পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে, মনোপলি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। যা দাম নির্ধারণ করেছে, সে দামে আমাদের কিনতে হবে। এত বড় অবিচার ভূ-ভারতে কোথাও আছে জানা নেই। আইন পরিবর্তন করে গণশুনানি তুলে দেওয়া হলে যাতে আমরা বলতে না পারি কত হাজার কোটি টাকা কোথায় চুরি হয়েছে। কোথায় লুটপাট হয়েছে, কীভাবে হয়েছে তা জানতে যেন না পারি সে কারণে।’
তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় দেখা গেলো জ্বালানি উন্নয়ন ফান্ডের ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয়নি। ৩৫ শতাংশ জ্বালানি কোথায় কীভাবে ব্যয় করেছে সেটা কেউ বলতে পারছে না। শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলে টাকা দিয়ে যাচ্ছি। এগুলো না দিলে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম কমতো। আমাদের টাকার ওপর সুদ নেওয়া হচ্ছে। এইভাবে আমরা ঠকছি।
তিনি বলেন, ট্রান্সমিশন ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কাছে ১৪ হাজার কোটি টাকা জমা আছে। তার আগে আইন করে বিদ্যুৎ খাত, জ্বালানি খাত হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। আমরা ফান্ড স্ট্যাবলাইজ ফান্ড করার কথা বলেছি। কিন্তু সেসব কথা শুনেনি। এখন ৮ ঘণ্টা, ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়।
আলোচনায় মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, গত এক বছরে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে। সর্বোচ্চ ২৫০০ মেগাওয়াট ও সম্প্রতি প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। কোথাও ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ থাকছে না।
তিনি বলেন, আপনারা হয়তো আজ, কাল দেখবেন না। আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি হলে দেখবেন না। কিন্তু আমাদের অনুমান হচ্ছে এই লোডশেডিং সহজে যাবে না। বাংলাদেশে আরও বেশ কিছু সময় থাকবে বলে আমাদের আশঙ্কা।
বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রায় বন্ধ থাকছে। আইপিপিগুলোর কাছে ২০ হাজার কোটি টাকার মতো পাওনা রয়ে গেছে জানিয়ে মোয়াজ্জেম বলেন, জ্বালানি আমদানি করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ দরকার তার জন্য যে এলসি খোলার দরকার বিপিসির সেটি খোলা যাচ্ছে না। বিপুল পরিমাণ ঋণ করা হচ্ছে কেবল জ্বালানি ব্যয় মেটানোর জন্য। এলএনজি আমদানি, বিদ্যুতে কৃচ্ছ্রনীতি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিসহ সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সেগুলো প্রকারন্তরে খাতসংশ্লিষ্ট সমস্যা থেকে উত্তরণে খুব বড় ভূমিকা রাখছে না।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের জেনারেশন ক্যাপাসিটি রয়েছে ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে অনগ্রিডে ২৪ হাজার আর অফগ্রিডে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট। এই বড় ক্যাপাসিটিটাই এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার পুরোটাই প্রায় আমদানিনির্ভর জ্বালানি। সরকারের নীতির বাইরে কয়লাভিত্তিক জ্বালানির আমদানি বাড়ছে। কয়লার শেয়ার এখন ১১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছেছে যেটা চার বছর আগেও অর্ধেকেরও কম ছিল। সরকার বলেছিল কয়লা থেকে সরে আসতে চায়, ১০টি প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরকার সরে আসার ঘোষণা দিয়েছিল। তা না করে আবার নতুন করে কয়লার ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে। উপরন্তু আরও প্রায় ছয় হাজার ১০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন পাইপলাইনে রয়েছে। যেগুলো কিন্তু সামনের দিনগুলোতে আসবে।
তিনি বলেন, আমরা এত বিদ্যুৎ দিয়ে কী করবো। এটি এখন নতুন একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি এর ব্যবহার আমরা না করতে পারি। এর ফলে যা হবে তা হলো- আমদানি করার জন্য যে ধরনের অর্থনৈতিক সামর্থ্য দরকার সরকারি এজেন্সিগুলোর সেগুলো দেওয়ার মতো সক্ষমতা এখন নেই, আগামী দিনে কীভাবে থাকবে সেটাও দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি ক্যাপাসিটি রয়েছে। বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি পেমেন্টের ধকলে, এটা বহন করা (আনবিয়ারেবল) কষ্টসাধ্য অবস্থায় চলে যাচ্ছি। বাংলাদেশে পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) তার ব্যয় মেটানোর জন্য সরকারের কাছ থেকে নিচ্ছে। টোটাল সাবসিডির ২৭ শতাংশ ভর্তুকি সাবসিডি দিতে হচ্ছে বিদ্যুৎখাতে। যার মূলে রয়েছে এই ক্যাপাসিটি চার্জ। অন্যান্য সামাজিক খাতে অর্থ দিতে পারছি না।
তিনি বলেন, একদিকে বিপিসি, পিডিবি বা বিপিডিবি লস করছে। অন্যদিকে তাদের সম্পদ বাড়ছে। আবার লসের অজুহাত দিয়ে ট্যারিফ বাড়িয়ে দিয়ে বাড়তি অর্থ নিচ্ছে। আবার সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিচ্ছে। আমাদের কাছে এই হিসাবটা গোলমেলে মনে হয়েছে। জ্বালানি খাত সমন্বয়ে আইএমএফের শর্তগুলো আমাদের কাছে অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে। যেভাবে বিদ্যুৎখাত এখন যেভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে, সেখান থেকে সরকারের সরে আসা জরুরি বলে আমরা মনে করছি।
প্রস্তাবিত বাজেটে জ্বালানি খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত চলমান সংকট থেকে সঠিকভাবে শিক্ষা নেয়নি। জ্বালানি বহুমুখীকরণের পরিবর্তে, কয়লার ওপর নির্ভরতা আরও বাড়ানো হয়েছে। যা সরকারি অবস্থানের বিরুদ্ধে। পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি খাতে অবহেলা রয়েছে। সিপিডি মনে করে লোডশেডিং আগামী মাস বা বছর অব্যাহত থাকবে যা পরিবার এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিপিসি, বিপিডিবি এবং পেট্রোবাংলার মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক হিসাব কোথাও স্বচ্ছ নয়। সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রফেসর ইজাজ হোসেন ও প্রফেসর বদরুল ইমাম প্রমুখ।