বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন মেরুকরণ, সহিংসতার ঝুঁকি বৃদ্ধি করবে

দ্য ডিপ্লোম্যাটের রিপোর্ট

বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন মেরুকরণ, সহিংসতার ঝুঁকি বৃদ্ধি করবে

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: গণতান্ত্রিক একটি নির্বাচন থেকে বহুদিক থেকে ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফাঁকফোকড় ছিল। হাজারো প্রার্থী, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনেক সংগঠন, বিশাল র‌্যালি, বিপুল পরিমাণ প্রেস এমনকি নজরকাড়া নির্বাচনী গান ছিল। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই ভোটে প্রতিযোগিতার কোনো চিহ্ন ছিল না। বেশির ভাগ ভোটারের অংশগ্রহণ ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবি তোলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলো। কিন্তু তা আওয়ামী লীগ সরকার প্রত্যাখ্যান করার পর নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি ও অন্য দলগুলো। অক্টোবরে মহাসমাবেশের পর বিএনপির বেশির ভাগ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে কর্তৃপক্ষ। নির্বাচন বর্জনের অর্থ হলো ৭ই জানুয়ারি ভোটকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার বহু আগেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া যে- বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদ নিশ্চিত করবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। এরপর নির্বাচন কমিশন যখন ঘোষণা করলো যে, ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ অথবা দলটি থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে ২৮৩টি আসনে জয়ী হয়েছে, তখন বিস্মিত হওয়ার কিছু ছিল না। ভোটকে বিশ্বাসযোগ্যতা দেয়ার জন্য অন্য আসনগুলোতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের প্রত্যাহার করেছে, যাতে তাদের মিত্ররা বা সাজানো বিরোধীরা জিততে পারেন। 

কিন্তু এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যখন আরও ৫ বছরের মেয়াদ নিশ্চিত করলো, তখন তা একটি ‘পিরিক বিজয়’ হিসেবে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। (এমন একটি বিজয়কে পিরিক বিজয় বলে আখ্যায়িত করা হয়, যে বিজয়ে বিজয়ীকে ভীষণ মূল্য দিতে হয়- যা তার পরাজয়ের সমতুল্য)। এই দলটির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গভীর ফাটল, যা ভোটের ফলে প্রকৃতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে নিবন্ধিত ভোটারদের শতকরা কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোট দিয়েছেন। কিন্তু সারাদিন ভোটকেন্দ্রগুলো দেখা গেছে শূন্য। এ জন্য এত বেশি সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন যে, এই সংখ্যাটা নিয়ে উচ্চ মাত্রায় সংশয় আছে। তবু ঘটনা যা-ই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত উচ্চ ভোট দেখানো হলেও তা সাম্প্রতিক দশকগুলোতে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে শতকরা ৭৫ থেকে ৮৫ ভাগ ভোটের চেয়ে অনেক কম। 

কোনো বাস্তব বিরোধী না থাকায়, ভোট দেয়ার আগ্রহ বেশিরভাগ ভোটারের মধ্যেই ছিল না বললেই চলে। কিন্তু ৭ই জানুয়ারি নির্বাচন বা সমালোচকদের মতে ‘সিলেকশন’ ছিল ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য একটি গণভোটের মতো। এই নির্বাচনে কম মাত্রায় ভোটার ভোট দেয়ার মধ্য দিয়ে সরকারের সাম্প্রতিক পারফর্মেন্সে ভোটারদের অসন্তোষ কোন পর্যায়ে তা প্রতিফলিত হয়েছে। দেশের ভিতরে সমালোচকদের বিরুদ্ধে কঠোর হাতে দমনপীড়ন, ব্যাপক বিস্তৃত দুর্নীতি ও দুষ্টচক্র বৃদ্ধি পাওয়ার ধারণা এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে ক্ষমতাসীন দলটির সমর্থন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই কারণগুলো বিরোধিতাকে নতুন একটি গতি দিয়েছে, যা কয়েক বছর আগেও শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। 

দেড় বছর ধরে বিএনপি বেশির ভাগই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছিল শেখ হাসিনাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য, যাতে ওই সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে পারে। কিন্তু তাদের দাবি কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে যখন ব্যর্থ হয়, তখন তারা লক্ষাধিক সমর্থককে ঢাকায় মহাসমাবেশে ডাকে। ২৮শে অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ পুলিশ ভণ্ডুল করে দেয়ার পর দলটির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে সরকার। নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্যতা করতে কিছু পদক্ষেপ নেয় আওয়ামী লীগ। তারা বিএনপিকে ভাঙ্গার চেষ্টা করে। এ জন্য বিএনপির সিনিয়র নেতাদের আশ্বস্ত করা হয় যে, যদি তারা নির্বাচনে আসতে রাজি হন তাহলে তাদেরকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হবে। শেষ পর্যন্ত একজন মাত্র ব্যক্তি সেই প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন। তার জামিন নিশ্চিত হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের টিকেট পাওয়ার জন্য আগেই মনোনীত হয়ে যান সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু পুরো বিএনপি এক থেকেছে। তারা সেভাবে টিকে আছে। একতার পরীক্ষায় টিকে আছে। তারা নির্বাচন বর্জনের প্রচারণায় থাকে। যদিও দলটির বেশির ভাগ সদস্য এবং নেতা জেলে, তবুও তারা একটি কার্যকর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে থেকে গেছে। 

এর ফলে বাংলাদেশ একটি সূক্ষ্ম অবস্থানে এসেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে আছে। কিন্তু তার বৈধতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান হারে বিতর্ক হচ্ছে। পরপর টানা তিনটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের পর ভোটারদের মধ্যে সর্বকালের সবচেয়ে বেশি হতাশা দেখা দিয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের আন্দোলিত করতে বিরোধী দলের অহিংস আন্দোলনের কৌশল এবং দলের ভাবমূর্তি দেশে এবং বিদেশে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কার্যকর ফল দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা খুব ঘন ঘন দেখা গিয়েছে, তা এর মধ্য দিয়ে বিদায় নিয়েছে। অন্যদিকে অহিংস এই আন্দোলন করলেও বিরোধীরা তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।  এখন রাজনৈতিক সহিংসতার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। দলটির বেশির ভাগ উদারপন্থি নেতা জেলে। ফলে দলটির কোনো অংশ থেকে বিরোধীদেরকে অতীতের ভয়াবহ সহিংসতায় ফেরাতে চাইতে পারেন। যদি এটা ঘটে তাহলে তা হবে মারাত্মক এক ভুল। কারণ, এর ফলে বিএনপিকে বাংলাদেশের জন্য সমস্যার একটি কারণ হিসেবে দেশে এবং বিদেশে দেখানোর সুযোগ করে দেয়া হবে আওয়ামী লীগ সরকারকে।  

এরই মধ্যে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে শেখ হাসিনা বিএনপির ওপর আরও দমনপীড়ন চালানোর পূর্বাভাস দিয়েছেন। তিনি সমর্থকদের বলেছেন, এই দলটির রাজনীতি করার অধিকার নেই। তবে এ কথা দিয়ে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন তা পরিষ্কার না হলেও বিএনপিকে নিষিদ্ধ করাটা হবে একটি ভুল। এমন পদক্ষেপ নেয়া হলে বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক প্রকৃত পছন্দ এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁকি থাকবে, এসব দেশের ওপর বাণিজ্যের জন্য নির্ভরশীল বাংলাদেশ। বাস্তবে ওই নীতি প্রয়োগ করা কঠিন হবে। ২০১৩ সালে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে জামায়াতে ইসলামীকে। কিন্তু উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এখনও তারা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিএনপিকে আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠানো হলে তাতে দেশ আরও মেরুকরণ হবে। এরই মধ্যে ছোট ছোট বিরোধী দল, যারা নির্বাচন বর্জন করেছে তারা বিএনপির সঙ্গে একক আন্দোলনে মিশে যাচ্ছে। এ দলটিকে নিষিদ্ধ করা হলে এই ধারা আরও ত্বরান্বিত হবে। একত্রিত হবে বামপন্থি, মধ্যপন্থি বিএনপি এবং ইসলামপন্থি শক্তিগুলো। 

যদিও বিএনপি এর মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা নির্বাচনের পরের সপ্তাহে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করবে না। অবরোধ দেবে না। কিন্তু সরকারকে দুর্বল করতে এবং তাকে পদত্যাগে বাধ্য করতে আরও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিরোধীরা চালাবে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। আওয়ামী লীগকে এই আন্দোলন ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে বলে মনে না হলেও সরকার মনে করতে পারে আন্দোলনকে আরও বৃদ্ধি পাওয়া রোধে অধিক কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে হবে। অতীতে যখন নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী বিরোধী শক্তিগুলোকে টার্গেট করেছে জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে, তখন এই প্রবণতা গভীর উদ্বেগের। 

অর্থনীতির ওপরও এর বড় রকম ক্ষতিকর প্রভাব থাকতে পারে। বিশেষ করে যখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে এবং মুদ্রাস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে রয়ে গেছে। অনিশ্চয়তা, অস্থিতিশীলতা এবং রাজপথে বড় রকম সহিংসতা হলে তাতে পলিসিমেকাররা স্থিতিশীলতার জন্য কঠোরতা অবলম্বন করতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আঘাত লাগতে পারে। বিশেষ করে ইমেজ নিয়ে সচেতন পশ্চিমা ব্রান্ডগুলো, যারা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক কেনে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ আসে এই তৈরি পোশাক খাত থেকে। 

আরও নিষ্পেষণ ও সহিংসতার একটি বিকল্প আছে। নির্বাচনী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিএনপিকে ফেরার পথ করে দিতে বড় দুটি দলের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলার জন্য একটি সংলাপ। তা হতে হবে উভয়পক্ষ থেকে ছাড় দেয়ার মাধ্যমে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে এই ছাড় আসতে হবে আওয়ামী লীগের দিক থেকে। কারণ, তারা এখন পরিষ্কার শক্তিশালী অবস্থানে। দেশের ভিতরে যে বিরোধীদেরকে মোকাবিলা করছে, তার সঙ্গে অর্থনীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক বিষয় মাথায় রেখে সমঝোতায় আসতে হবে ক্ষমতাসীন দলকে। এটা শুরু করতে বিএনপি নেতাদেরকে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করার বিনিময়ে তাদেরকে জামিন দেয়া উচিত সরকারের। তারপর উত্তেজনাকে প্রশমিত করতে আরও পদক্ষেপ নিতে পারে ক্ষমতাসীন দল। এর মধ্যে বিএনপির প্রধান অসুস্থ খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে দেয়ার অনুমোদন। অন্যদিকে বিএনপিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের হার্ডলাইন শিথিল করা উচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে দুটি দলের কাজ করার জন্য একমত হওয়া চরমমাত্রায় চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশের ১৭ কোটি নাগরিকের জন্য দুই দলকেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেখানো উচিত এবং ‘জিরো সাম’ রাজনীতি থেকে সরে আসা উচিত। বিদেশি সরকারগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত- যারা ঢাকায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে, ৭ই জানুয়ারির অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের প্রেক্ষিতে উভয় পক্ষকে আলোচনায় বসাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত তাদের। 

(লেখক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়া প্রোগ্রাম ডিরেক্টর। তার এ লেখাটি অনলাইন দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুবাদ)