পরিশ্রমে গড়া ঘরবাড়ি এখন শুধুই স্মৃতি

সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব তারা। তাদের মতো বাড়িঘর হারিয়েছে সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলার দুই উপজেলার ছয় শতাধিক পরিবার।

পরিশ্রমে গড়া ঘরবাড়ি এখন শুধুই স্মৃতি
বন্যায় নিয়ে গেছে চায়না আক্তারের ভিটেমাটিও

প্রথম নিউজ, নেত্রকোনা: চায়না আক্তার (৪৫)। জেলার দুর্গাপুর উপজেলার গাঁওকান্দিয়া গ্রামে ৪০ শতক জায়গায় ছিল তার বাড়ি। বাড়িতে দুটি আধাপাকা ঘর এবং একটি টিন শেড ঘর ছিল। গেলো ১৭ জুন সকাল পৌনে ৮টার দিকে ঘরের ভেতর হঠাৎ পানি দেখতে পান। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক বুক পানি হয়ে যায়। একমাত্র সন্তানকে ওড়না দিয়ে বেঁধে ভেসে যান পানিতে।

কিছুক্ষণ পর একটি বাঁশঝাড় আঁকড়ে ধরেন তিনি। মুহূর্তেই ছেলেকে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে ফেলেন। পৌনে ছয় ঘণ্টা পর তাদের উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। নেওয়া হয় আশ্রয়কেন্দ্রে। পানি কমলে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে আর কিছুই পাননি। ঘরবাড়ি, গাছপালা এমনকি ভিটেটাও নেই। সব হারানোর শোকে কেঁদেই যাচ্ছেন চায়না আক্তার।

একই গ্রামের পল্লী চিকিৎসক ইসলাম উদ্দিন (৬৮)। সকালে নামাজ পড়ে একটু ঘুমিয়ে যান। ৮টার দিকে হঠাৎ পানি ওঠায় দুই নাতি ও পুত্রবধূকে নিয়ে ভাসতে থাকেন। সবাইকে নিয়ে সাঁতরাতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় লোকজন নৌকা দিয়ে তাদের উদ্ধার করেন।

ইসলাম উদ্দিন বলেন, ১৫ লাখ টাকা খরচ করে ঘর বানিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ঈদে ছেলে বাড়ি এলে নতুন ঘরে উঠবো। বন্যায় সেই ঘর ভেসে গেছে। বন্যার পানিতে একই এলাকার স্কুলশিক্ষক শামছুল ইসলাম, তার ভাই রহিত মিয়া, আব্বাস উদ্দিন, মুসলিম উদ্দিন, আব্দুল খালেক সরকারের ঘরবাড়িও ভেসে গেছে। সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব তারা। তাদের মতো বাড়িঘর হারিয়েছে সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলার দুই উপজেলার ছয় শতাধিক পরিবার। পরিশ্রমে গড়া ঘরবাড়ি এখন শুধুই স্মৃতি।

দুর্গাপুর পৌরসভার ভবানীরপুর গ্রামের রহিমা খাতুন বলেন, ১৭ জুন হঠাৎ বন্যার পানি ওঠে। খাটের ওপর কোমর পানি। আমার স্বামী সিদ্দিক মিয়াও হতবাক। ১৮ জুন আমাদের উদ্ধার করা হয়। আমার সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

আদিবাসী কমিউনিটির নেতা ও বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির পরিচালক সুজন হাজং বলেন, এ বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সীমান্তের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন। তাদের বাড়িঘর চলে গেছে। জমি নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর পরিদর্শন করে দ্রুত তাদের ঘরবাড়ি সংস্কারের দাবি জানাই।

দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিব উল আহসান বলেন, উপজেলার অন্তত দেড় থেকে ২০০ বাড়িঘর ভেঙে গেছে। পথঘাটের ক্ষতি হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরি করছি। রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণের কাজ চলছে। ক্ষতির তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।

কলমাকান্দার ইউএনও মো. আবুল হাসেম বলেন, উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নসহ কয়েকটি গ্রামে সাড়ে ৪০০ ঘরবাড়ির ভেঙে যাওয়ার তালিকা করা হয়েছে। আরও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। প্রায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, হাসপাতাল যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই হাজার হাজার বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। বেশিরভাগ বাড়িঘরে এখনো বন্যার পানি। পানি কমলেও তারা বাড়িতে ফিরতে পারছেন না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড নেত্রকোনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহনলাল সৈকত বলেন, জেলার কংস, সোমেশ্বরী, উব্দাখালী, ধনুসহ ছোটবড় সব নদনদীর পানি গত তিনদিন ধরে কমতে শুরু করেছে। তবে উব্দাখালী নদীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ও ধনু নদের খালিয়াজুরি পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপর দুটি পয়েন্টের বিপৎসীমার ৬ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, নেত্রকোনার ৯টি উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে গত দুদিনে ৮৫ হাজার ১৭ জন মানুষ বাড়ি ফিরেছে। ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট থেকে পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়েছেন। তবে ২৮৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো ২৪ হাজার ৫১৮ জন অবস্থান করছেন। এরমধ্যে ২ হাজার ৯০৬ জন শিশু ও ২০৯ জন প্রতিবন্ধী রয়েছেন।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom