নওগাঁয় ইন্টার্ন নার্সদের কর্মবিরতিতে দুর্ভোগ বেড়েছে রোগীদের
রোগী ভর্তির সংখ্যা হাসপাতালটিতে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে ইন্টার্ন ভাতা চালুর দাবিতে গত ১ অক্টোবর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি পালন করছে নার্সিং ইনস্টিটিউটের নার্সরা।
প্রথম নিউজ, নওগাঁ: ২৫০ শয্যা হলেও প্রশাসনিক অনুমোদন না পাওয়ায় এখনো পূর্ণাঙ্গ জনবল পায়নি নওগাঁ জেনারেল হাসপাতাল। তবে রোগী ভর্তির সংখ্যা হাসপাতালটিতে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে ইন্টার্ন ভাতা চালুর দাবিতে গত ১ অক্টোবর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি পালন করছে নার্সিং ইনস্টিটিউটের নার্সরা।
এতে জনবল সংকটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত নার্সদের। যা রোগীদের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ জনবল সরবরাহসহ সৃষ্ট সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, ১০০ শয্যা সদর হাসপাতাল হিসেবে সেবা প্রদানের দীর্ঘ ২২ বছর পর ২০১৯ সালে নতুন ১৫০ শয্যার ৮ তলা বহুতল ভবন পেয়ে ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয় নওগাঁ জেনারেল হাসপাতাল। ২০২০ সালের ৩১ আগষ্ট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এই হাসপাতালটির ২৫০ শয্যায় সেবা কার্যক্রম চালুর প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে নতুন ভবনটি রোগীদের সেবায় পুরোপুরি ব্যবহার শুরু করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে নতুন ভবন চালুর পরই পুরাতন ভবনটির ১০০ শয্যার কক্ষগুলো মেডিকেল কলেজের প্রয়োজন হওয়ায় সেটি তাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। বর্তমানে নতুন ভবনের ১৫০ শয্যায় দৈনিক গড়ে ২৩০ জন রোগী ভর্তি থাকে এবং ১২০ জন রোগী দৈনিক ভর্তি হচ্ছেন। তবে ২৫০ শয্যার অনুমোদনের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও প্রয়োজনীয় জনবল, ওষুধ ও খাবারের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ। ২৫০ শয্যা হিসেবে এই হাসপাতালে ৬৭ জন চিকিৎসক ও ২ শতাধিক নার্স থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৩০ জন চিকিৎসক ও ৮২ জন নার্স। এতে পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সেবা প্রত্যাশীরা।
বুধবার (৪ অক্টোবর) জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ৮ তলা বহুতল ভবনে শয্যা সংকটে অর্ধেকের বেশি ভর্তি রোগীর ঠাঁই হয়েছে মেঝেতে। জরুরি প্রয়োজনে নার্সদের ডাকতে গিয়ে সময়মতো কাছে পাচ্ছেন না রোগীর স্বজনরা। নার্স ডেস্ক বেশিরভাগ সময়ই ফাঁকা থাকছে। এতে হাসপাতালে মাঝে মধ্যেই সৃষ্টি হচ্ছে হট্টগোল। নার্সিং ইনস্টিটিউটের ৭৫ জন ইন্টার্ন নার্স ও মিডওয়াইফদের কর্মবিরতীতে ক্রমাগত রোগীদের এই দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।
জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন নওগাঁ সদর উপজেলার দুবলহাটি ইউনিয়নের দুবলহাটি গ্রাম থেকে আসা বৃদ্ধ জছির উদ্দিন। পাশেই স্বজনরা বসে দুঃশ্চিন্তায় প্রহর গুনছেন। সেখানে কথা হয় জছির উদ্দিনের ছোট ভাই মোনতাজ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভাই হঠাৎ স্ট্রোক করায় ভোর ৪টার দিকে তাকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে এনে ভর্তি করিয়েছি। ভর্তি করার পর একজন নার্সকেও ওয়ার্ডের ডেস্কে পাইনি। প্রায় ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করার পর নার্স এসেছে। ওয়ার্ডে নার্স কম থাকায় দিনের বেলাতেও তাদের ডেকে সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না। রোগীর উপচে পড়া ভিড়, অথচ বেড নেই।
একই ধরনের অভিযোগ করেন শহরের আরজী নওগাঁ মহল্লা থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা আব্দুল লতিফ। তিনি বলেন, পাইলস এর সমস্যায় ১ দিন আগে ভর্তি হয়েও ওয়ার্ডের ভেতরে বেড পাইনি। তাই মেঝেতে বিছানা পেড়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। ভর্তি হওয়ার পর থেকে নার্সদের ব্যবহার ভালো পাচ্ছি না। তাদের ডাকলে সহজে আসতেই চাচ্ছে না। তাই হাসপাতালে নার্সের সংখ্যা এবং শয্যা আরও বাড়ানো উচিত।
ইন্টার্ন নার্স না থাকায় সৃষ্ট সংকট নিয়ে কথা হয় হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগের নার্সদের ইনচার্জ মঞ্জিলা পরভীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই বিভাগে যে পরিমাণ শয্যা রয়েছে তার চেয়ে চারগুণ বেশি রোগী প্রতিনিয়ত ভর্তি থাকে এবং থাকছে। তাই অন্যান্য ওয়ার্ডের তুলনায় এখানে চাপ বেশি। এই চাপ সামাল দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় নিয়োগপ্রাপ্ত নার্স এই হাসপাতালে নেই। তাই ইন্টার্ন নার্সদের সহযোগিতা নিয়েই চাপ সামাল দিতে হয়। তাদের আকস্মিক কর্মবিরতিতে রোগীদের সামাল দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে।
কর্মবিরতির বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্নরত নার্স শাকিল খাঁন জয়, ইসমাইল হোসেন ও নাফিসা তাবাসসুম বলেন, হাসপাতালে কর্মরত নার্সদের মতোই আমাদেরকেও দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। দীর্ঘসময় শ্রম দিতে গিয়ে অনেক কিছু শিখছি। তবে এই ছয় মাস মেসে থাকা খাওয়া সম মিলিয়ে প্রতি মাসে কমপক্ষে ৭ হাজার টাকা খরচ গুনতে হয়। ইন্টার্নশিপের লকবুকের ১৪ পৃষ্ঠায় কোড অব কন্ডাক্টে প্রতি মাসে কমপক্ষে ৬ হাজার টাকা ইন্টার্ন ভাতা প্রদানের কথা উল্লেখ আছে। অথচ সেই ভাতা আমাদেরকে দেওয়া হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে রাজপথে নেমেছি। আমাদের দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত এই কর্মবিরতি পালন অব্যাহত থাকবে।
ডিপ্লোমা ইন্টার্ন নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন নওগাঁ নার্সিং ইনস্টিটিউট শাখার সভাপতি ফারুক হোসেন বলেন, ১ অক্টোবর থেকে হাসপাতালে না গিয়ে প্রতিদিন রাস্তায় ব্যানার প্ল্যাকার্ড হাতে আন্দোলন করাটা আমাদের জন্যও কষ্টকর। এই কর্মবিরতির কারণে অনেক রোগীর কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় আমাদের হাতে ছিল না। ইন্টার্ন ভাতা পাওয়ার যথেষ্ট অধিকার আমাদের রয়েছে। ভাতা চালু করলে তবেই আমরা হাসপাতালে ফিরব।
নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, ইন্টার্ন নার্সদের দাবিটি যৌক্তিক বলে মনে করছি। তাদের কর্মবিরতির পর অধিদপ্তর থেকে ইন্টার্ন নার্সদের ভাতা প্রদানে কত টাকা প্রয়োজন সে বিষয়ে জানতে একটি চিঠি আমাকে পাঠানো হয়েছে। শীঘ্রই ওই চিঠির জবাব দেওয়া হবে। আশা করছি বর্তমানে সৃষ্ট এ সংকট দ্রুত কেটে যাবে এবং নার্সরা তাদের কর্মবিরতির সুফল পাবে।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) নাসির উদ্দিন বলেন, ডাক্তাররাও ইন্টার্ন করার সময় ভাতা পায়। তাই ইন্টার্ন নার্সদের ভাতার দাবিটি নিঃসন্দেহে যৌক্তিক। তাদের দাবিগুলো অনেক আগে থেকেই আমাদেরকে অবগত করা হয়েছিলো। তাৎক্ষণিক সেটি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কেও অবগত করা হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে এখনো সাড়া পাওয়া যায়নি। নির্দেশনা পেলে ইন্টার্ন নার্সদের ভাতা চালু করা হবে।