যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে তিস্তা প্রসঙ্গ না তোলার বার্তা নয়াদিল্লির

 তিস্তার জট খোলা নিয়ে বাংলাদেশের জন্য কোনো সুসংবাদ থাকছে না , বৈঠকে তিস্তা প্রসঙ্গ না তোলার বার্তা নয়াদিল্লির, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরের কথা রয়েছে, তিস্তার পানি নিয়ে কিছু না হলেও কুশিয়ারায় সমঝোতা হতে পারে 

যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে তিস্তা প্রসঙ্গ না তোলার বার্তা নয়াদিল্লির

প্রথম নিউজ, ঢাকা:  এক যুগেরও বেশি সময় পর বৈঠকে বসছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি)। দুই দেশের মধ্যে বহমান ৫৪টি নদীর মধ্যে যে অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে, বৈঠকে সেসবের কোনো কোনোটির সমাধানের ইঙ্গিত রয়েছে। তবে বহুল প্রতিক্ষীত তিস্তার জট খোলা নিয়ে বাংলাদেশের জন্য কোনো সুসংবাদ থাকছে না। ভারতের দিক থেকে চাওয়া বৈঠকে তিস্তার ইস্যুটি যেন ওঠানোই না হয়। যদিও ঢাকা বলছে, আলোচনায় তিস্তাতে ইস্যুতে জোর দেওয়া হবে। 

নয়াদিল্লি বলছে, তিস্তা আলোচনায় থাকলে দীর্ঘ বিরতির পর অনুষ্ঠেয় বৈঠকে ভালো কিছু হবে না। অন্যদিকে ঢাকা বলছে, নয়াদিল্লি তিস্তা নিয়ে অনাগ্রহ দেখালেও আলোচনায় তিস্তাতে জোর দেবে ঢাকা। আর এই চাপ কিংবা আলোচনা তিস্তার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত জিইয়ে রাখা হবে। তবে এবারের জেআরসিতে তিস্তা ইস্যুতে অগ্রগতি হচ্ছে না বলেই ধরে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।  

জেআরসি ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরের কথা রয়েছে। ওই বৈঠককে সামনে রেখে জেআরসিতে কুশিয়ারা নদীর বিষয়ে সমাধানে পৌঁছাতে চায় ঢাকা। প্রধানমন্ত্রীর সফরে আনুষ্ঠানিকভাবে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এই সমঝোতা স্মারকের আলোকে বাংলাদেশ কুশিয়ারা নদীর পানি রহিমপুর খাল দিয়ে কৃষিকাজে ব্যবহার শুরু করার পর ভারতকে প্রতিদিন ফেনী নদীর ১.৮২ কিউসেক পানি দেবে। ২০১৯ সালে দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে সরবরাহ করা হবে, যাতে সেখানে পানীয় জলের প্রয়োজন মেটানো যায়।

গঙ্গা নদীর ওপর অবকাঠামো নির্মাণ এবং বছর চারেক পরে শেষ হতে যাওয়া গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তির মেয়াদ সময়ভিত্তিক না করার বিষয়েও আলোচনা করবে ঢাকা। অন্যদিকে ছয়টি অভিন্ন নদী নিয়ে আলোচনা হবে। আর নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে গুরত্ব দেওয়া হবে বলে ইঙ্গিত রয়েছে। 

কূটনৈতিক সূত্র বলছে, তিস্তা, গঙ্গা কিংবা ছয়টি অভিন্ন নদীর বাইরে সাম্প্রতিক বর্ষায় দুই দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদীর পানি বেড়ে তীরবর্তী অঞ্চলে বন্যা প্রসঙ্গও থাকবে আলোচনার টেবিলে। গত জুন-জুলাই মাসে অতি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নদীর পানির স্তর বেড়ে যাওয়ায় ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম ও তার সীমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে ব্যাপক বন্যার ঘটনা আমলে নিয়ে এ ধরনের দুর্যোগ প্রতিরোধে যৌথভাবে কাজ করতে চাইবে যৌথ নদী কমিশন।  

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘ সময় বিরতির পর জেআরসি হচ্ছে। প্রায় ১২ বছর পর হতে যাওয়া বৈঠকটি নয়াদিল্লিতে হবে। আগামী ২৩ আগস্ট পানিসচিব পর্যায়ে এবং একদিনের বিরতি দিয়ে ২৫ আগস্ট মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকে কুশিয়ারা আসবে, তিস্তা আসবে, ছয়টি অভিন্ন নদী আসবে। মোটা দাগে দুই দেশের পানি সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো আলোচনায় আসবে। কোনোটাতে হয়তো অগ্রগতি আসবে, আবার কোনোটাতে অগ্রগতি নাও আসতে পারে।

যৌথ নদী কমিশনের তথ্য বলছে, নয়াদিল্লিতে জেআরসি বৈঠকে ঢাকার পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। আর নয়াদিল্লির পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন দেশটির জলশক্তি মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস বলেন, অনেক বছর পর জেআরসি হচ্ছে। এবারের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে, ১২ বছর পর বৈঠকটা হচ্ছে। এটা একটা গুরত্বপূর্ণ ফোরাম। ছয়টি অভিন্ন নদী, কুশিয়ারা বা অন্য নদীগুলোর ক্ষেত্রে ফোরামগুলোতে যে অগ্রগতি হয়েছে, সেগুলো আবার আলোচনায় আসবে। আর যেগুলোর ক্ষেত্রে সমাধানে পৌঁছানো যায়নি, হয়তো সামনে উভয়পক্ষের সম্মতিতে সেগুলোতে ভালো কিছু হতে পারে। 

যৌথ নদী কমিশনের এক সদস্য জানান, জেআরসির পরপরই প্রধানমন্ত্রী ভারত যাবেন। এবারের বৈঠকের উদ্দেশ্য বা আমাদের চাওয়া থাকবে অন্ততপক্ষে কুশিয়ারার এমওইউটা যেন সাইন হয়। এটা আমাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট। যেহেতু আমরা ফেনী নদী থেকে ভারতকে ১.৮২ কিউসেক খাবার পানি মানবিক কারণে ভারতকে দেওয়ার বিষয়ে এমওইউ করেছিলাম। আমরা ওখানে কোনো ইমপ্লিমেনটেশনে যাইনি, শুধু এমওইউ করেছি। যদি এবারে কুশিয়ারা সাইন হয়, তাহলে রহিমপুর খাল থেকে কৃষিকাজের জন্য আমরা যখন পানি নেওয়া শুরু করব; ঠিক একই সময়ে ফেনী নদী থেকে ভারতে পানি দেওয়ার বিষয়ে যে এমওইউ স্বাক্ষর হয়েছিল, সেটার ইমপ্লিমেনটেশানের দিকে নিয়ে যাব।

কূটনৈতিক সূত্রের তথ্য বলছে, এবারেরর জেআরসিতে তিস্তা প্রসঙ্গ না আনার জন্য বার্তা দিয়েছে নয়াদিল্লি। আর তিস্তাতে অনাগ্রহের ব্যাখ্যায় তারা বলছে, আলোচনায় তিস্তা থাকলে অন্য নদীর ক্ষেত্রে সুরাহা বা বৈঠকে ভালো কিছু হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।

নয়াদিল্লি আলোচনায় তিস্তা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চায়। তবে কি ঢাকার পক্ষ থেকে তিস্তা বাদ দিয়েই আলোচনা হবে জেআরসিতে? এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব (পূর্ব) মাশফি বলেন, ওদের (ভারত) চাওয়া না চাওয়া না, আমরা বিষয়টা তুলবই। আমাদের লাইফলাইন তিস্তা। তিস্তাটা আমাদের অবশ্যই তুলতে হবে। আমরা অবশ্যই তুলব এবং সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে থাকবে। তারা মমতা ব্যানার্জিকে রাজি করাতে পারুক, না পারুক এটা তাদের ইস্যু। একই বার্তা দেন যৌথ নদী কমিশনের এক সদস্যও। তিনি বলেন, যখনই আমরা যৌথ আলোচনায় বসি, সেটা যে সফল হবে তা ভাবা ঠিক হবে না। মিটিংগুলো করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভারতকে সবসময় একটা চাপের মধ্যে রাখা, যেন কোনো একটা জায়গায় সাফল্য আসে। আমরা তাদের বারবারই চাপ দেই, আমরা তিস্তা নিয়ে এখনও উদ্বিগ্ন, আমরা কুশিয়ারা নিয়ে উদ্বিগ্ন, আমরা ছয় নদীর একটি খসড়া চাই। 

তিনি বলেন, তিস্তা অবশ্যই এবারও আমাদের আলোচনায় থাকবে। এটা নিয়ে আমরা সব সময় তাদের ওপর একটা চাপ দিতে থাকি, এবারও আমরা চাপ দেব ভারতকে। এটার ফলাফল কী হবে এই মুহূর্তে বলা যাবে না। আর ছয় নদীর ব্যাপারে আমরা তথ্য বিনিময় করেছি, সেটা নিয়েও আমরা আলোচনা করব।

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, আমরা প্রস্তুত ছিলাম, তারাও প্রস্তুত ছিল। তবুও চুক্তিটি হয়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আমরা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে পারিনি। তবে আমরা আশাবাদী। তিস্তা হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিভিন্ন নদীর জলসম্পদ বণ্টন, সেচ এবং বন্যা ও এই জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ যৌথভাবে মোকাবিলা করতে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে সমঝোতার মধ্যে দিয়ে গঠিত হয় যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি)। সবশেষ, ২০১০ সালে জেআরসি বৈঠক হয়েছিল।  

ভারতের হুগলী নদীতে পানি সরবরাহ এবং কলকাতা বন্দরটি সচল করার জন্য ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। যার অবস্থান বাংলাদেশ থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে ভারতের ভূখণ্ডে গঙ্গা নদীর ওপরে। ভারত যেভাবে গঙ্গা নদীর ওপরে ফারাক্কা পয়েন্টে একটি ব্যারেজ নির্মাণ করেছে, সেরকম বাংলাদেশও গঙ্গা নদীর ওপর অবকাঠামো নির্মার্ণের কথা ভাবছে। তবে সেটি অবশ্যই পরিবেশের জন্য যেন ক্ষতির কারণ না হয় ও সে বিষয়ে যৌথ সমীক্ষার মাধ্যমে সামনে এগোতে চায় বাংলাদেশ। আর এটা এবারের জেআরসি বৈঠকের মূল ইস্যু হিসেবে আলোচনায় আসতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন যৌথ নদী কমিশনের এক সদস্য। 

এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, আমরা একটা যৌথ সমীক্ষা করতে চাচ্ছি। ভারত যেমন গঙ্গা নদীর ওপরে ফারাক্কা পয়েন্টে একটি ব্যারেজ করেছে, সেরকম আমরাও গঙ্গা নদীর ওপর কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারি কি না, যেটা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না, যার জন্য আমাদের যৌথভাবে একটা টিমওয়ার্ক তৈরি করেছি। দুই দলের মধ্যে একটা কমিটিও ফরমেশন হয়েছে। এখন আমরা এটাকে যৌথভাবে চূড়ান্ত করে স্টাডির দিকে নিয়ে যেতে পারি। স্টাডি করলেই যে, এটা করতে হবে তা নয়। তবে এটা একটা মাইলফলক হতে পারে যে যৌথভাবে দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা একটা স্টাডি করেছে। এটাই হচ্ছে এবারের মূল ইস্যু।

ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ কমতে থাকার প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি হয়। আর চার বছর পরেই এ চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আবার নতুন করে চুক্তি করতে হবে। এবারের জেআরসিতে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির প্রসঙ্গটি আসবে বলে ইঙ্গিত রয়েছে।     

এ প্রসঙ্গে কমিশনের এক সদস্য জানান, এবারের আলোচনায় গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তিটি আমরা সামনে আনতে চাই। এটা আলোচনা হবে। ২০২৬ সালের আগে যেন আমরা একটা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি, এবার আলোচনা হলে সেটা আমাদের জন্য আগাম প্রস্তুতি হতে পারে। আমরা চুক্তিতে এবার আর সময় চাচ্ছি না। মূল কথা হলো, আমরা সময়ভিত্তিক চুক্তি করতে চাই না। যেন ৩০ বছর, ৪০ বছর বা ২০ বছর পর আর নতুন করে নবায়নের বিষয়টা আর না আসে। যতগুলো অভিন্ন চুক্তি যেমন- ভারত ও পাকিস্তানের যে চুক্তিগুলো হয়েছে, এগুলো সময়ভিত্তিক চুক্তি হয়নি। আমরাও এবার চেষ্টা করব এই কৌশল অবলম্বন করতে, যেন আমাদের চুক্তিগুলো সময়ভিত্তিক না হয়। 

বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রথম দিল্লি সফরে যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের সময় বিষয়টি উত্থাপন করেন তিনি। তারপর ২০২১ সালের মার্চে নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে এলে সে সময়ও দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল তিস্তা। কিন্তু সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে তিস্তার অচলাবস্থা কাটছে না।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom