জেলায় জেলায় বিক্ষোভের ডাক বিএনপি’র
গতকাল নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে এই বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বিএনপি। গতকাল নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে এই বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই নয়াপল্টন ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভিড় করেছেন বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী। তীব্র গরম উপেক্ষা করে নেতাকর্মীরা সড়কের ওপর বসে শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য শোনেন। বেলা ২টার আগেই বিক্ষোভ সমাবেশস্থল, সড়ক ও বিভিন্ন অলিগলি মানুষের ভিড়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ঈদুল ফিতরের পর এটি ছিল রাজধানীতে দলটির প্রথম কোনো কর্মসূচি। ঘূর্ণিঝড় মোখার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে মোনাজাতের মাধ্যমে শুরু হয় সমাবেশ।
নয়াপল্টনের বিক্ষোভ- সমাবেশ থেকে সাংগঠনিক ৮২টি জেলা ও মহানগরে চারদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অধীনস্থ আদালত এবং সরকারের অবজ্ঞা, গায়েবি মামলায় নির্বিচারে গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা ও পুলিশি হয়রানি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুতের লোডশেডিং, সরকারের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির প্রতিবাদে এবং ১০ দফা দাবি বাস্তবায়নের দাবিতে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। চলতি মাসেই চারটি ভাগে জেলা ও মহানগর পর্যায়ে এই বিক্ষোভ-সমাবেশ করবে বিএনপি।
দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে নয়াপল্টনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিক্ষোভ-সমাবেশ শুরু হয়। বিকাল ৫টা ২৪ মিনিটে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন- বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে এদেশে কোনো নির্বাচন হবে না, হতে পারে না। নির্বাচন এদেশের মানুষ রুখে দেবে। আমরা কখনোই নির্বাচনের বিরুদ্ধে না। আমরা চাই সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। বিএনপি যখনই ক্ষমতায় এসেছিল, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন না দিলে, সে নির্বাচন রুখে দিতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
ফখরুল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল করে অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। আজ তারাই সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বাতিল করে এক দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য মানুষকে হত্যা করছে। ইতিমধ্যে আমাদের ১৭ জন নেতা প্রাণ দিয়েছেন। হাজার হাজার নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন, আর কত এভাবে আপনারা দমন করতে চান? বিএনপি মহাসচিব বলেন, আজকে শুধু সমুদ্রে ঝড় নয়, রাজনীতিতেও ঝড় উঠেছে। অবিলম্বে সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এটাই আপনাদের বাঁচার পথ।
৪৭ বছর পর জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর মূল কারণ হলো- জনগণের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করা। একই কায়দায় তারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে করেছিল। এভাবে নির্বাচনের আগে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। তবে কোনো ধানাই-ফানাই করে বা কেরিকাটা করে লাভ হবে না। ইনশাআল্লাহ্ জনগণের বিজয় হবেই।
সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই দেশে উচ্চ আদালত জামিন দেন কিন্তু নিম্নœ আদালত তা বাতিল করে দেন। যেখানে কোনো ঘটনাই ঘটেনি, সেখানে ককটেল ফাটানোর মামলা দেয়া হয়। এসবের উদ্দেশ্য হচ্ছে- আবারও গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকা। সেজন্যই আবারও গায়েবি ও মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের সমাবেশ। আজকে রিকশাওয়ালা সারাদিন পরিশ্রম করে বাসায় গিয়ে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। দিন আনে দিন খায় এমন লোকেরা আজকে অসহায়। তিনি বলেন, এই সরকার শুধু দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের পকেট ভরছে। সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা কেটে বিদেশে পাচার করছে। প্রত্যেকটি খাতে সাধারণ মানুষকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে। হজের বিমান ভাড়াও তারা বাড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই সরকার তিনটি দেশ সফর করেছে। কিন্তু কোনো অর্জন নেই। সবার সঙ্গে মিটিংয়ে নির্বাচনের প্রসঙ্গটি এসেছে। কারণ বিদেশিরা দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন দেখতে চায়। দেশে-বিদেশে এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। তারা নির্বাচন করতে গেলে রুখে দেয়া হবে। আমরা সত্যিকার অর্থেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় দেখতে চাই। এই দাবিতেই আমরা দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন করছি। আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপি’র হাজারো নেতাকর্মীকে খুন করা হয়েছে। ৪০ লাখ মানুষকে আসামি করে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি সবকিছু ধ্বংস করা হয়েছে। ৭১ সালের মতো গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হলে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
বিএনপি ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আযম খান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, রুহুল কবির রিজভী, এডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, আজিজুল বারী হেলাল, মীর সরাফত আলী সপু, রকিবুল ইসলাম বকুল, তাইফুল ইসলাম টিপু, শিরিন সুলতানা, আব্দুল খালেক, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, এসএম জিলানী, সাইফ মাহমুদ জুয়েল প্রমুখ।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে একটি ক্রান্তিকাল চলছে। দীর্ঘদিন থেকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হচ্ছে, কোনোভাবে সরকার ঠেকাতে পারছে না। তাদের সিন্ডিকেট এই দাম বাড়াচ্ছে। দেশে গণতন্ত্র নেই। ফলে এই সরকারকে আর ক্ষমতায় রাখা যায় না। কোনো ফ্যাসিবাদী সরকার নিজে থেকে ক্ষমতা ছেড়ে দেয় না। তাই, আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারকে বিদায় করতে হবে।
মির্জা আব্বাস বলেন, সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা বলেন- বিএনপি ভিন্ন পথে ক্ষমতায় আসতে চায়। সরকারকে বলবো, বিএনপি ভিন্নপথে ক্ষমতা আসার চিন্তাও করে না। বরং এই সরকার ভিন্ন পথে ক্ষমতায় টিকে থাকতে নানা ষড়যন্ত্র করছে। গয়েশ^র চন্দ্র রায় বলেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বলে থাকেন, তাদের ওপর কোনো চাপ নেই। তার মানে বুঝতে হবে এই সরকারের ওপর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট করার ব্যাপারে চাপ আছে। দেশে-বিদেশে কেউ এই সরকারকে চায় না। এই সরকার বলে, সংবিধান অনুযায়ী দেশে নির্বাচন হবে। আমার প্রশ্ন সংবিধানে কি এই সরকারকে বিরোধী নেতাকর্মীদের গুম করা, খুন করা, গায়েবি মামলা দেয়া, দুর্নীতি-পাচার করার অধিকার দিয়েছে? সংবিধানের মধ্য থেকে আমরা আন্দোলন করছি। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে ’৭১ সালের মতো আরেকটি আন্দোলন হবে, এজন্য প্রস্তুতি নিন।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, সরকারের মন্ত্রী-এমপি-নেতারা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সংবিধানের লঙ্ঘন হবে, তাহলে যেদিন বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেদিন কি সংবিধান লঙ্ঘিত হয়নি? আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এই সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য ভোটচুরির প্রকল্প নিয়েছে। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে, তাকে জামিন দেয়া হয়নি, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দেয়া হয়, যুক্তরাজ্যে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকে দ্বিপক্ষীয় বলে চালিয়ে দেয়া, দেশে-বিদেশে মিথ্যাচার করা, ব্যাংক লুটপাট করে বিদেশে পাচার করলেও ব্যবস্থা নেয়া হয় না।
এই ভোটচুরির সাথে যারা জড়িত তাদের কাউকে রেহাই দেয়া হবে না। স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে আর সময় দেয়া যায় না। ভোটারবিহীন কোনো নির্বাচন এ দেশে আর হতে দেয়া হবে না। নেতাকর্মীদের বলব, আপনারা এই সরকারের বিদায় ঘটাতে প্রস্তুতি নিন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এক সময় যারা চেয়ে খেত, তারা এখন শিল্প কলকারখানার মালিক, গণমাধ্যমে এসেছে, এই সরকারের শিল্প প্রতিমন্ত্রী এ কথা বলেছেন। এই কথা বিএনপি’র কোনো নেতা বলেননি। এই সরকার দুর্নীতিবাজদের সরকার। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম বলেছেন, বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা করার ধরন পাল্টিয়েছে। আগে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করতো, এখন ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের ধরে এনে মামলা দেয়। নয়াপল্টনের বিক্ষোভ সমাবেশ সঞ্চালনা করেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি’র সদস্য সচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণের রফিকুল আলম মজনু।
নতুন কর্মসূচি: বিএনপি মহাসচিব বলেন, আগামী ১৯শে মে শুক্রবার ঢাকা মহানগর উত্তরসহ ২৮ জেলা ও মহানগর, ২০শে মে শনিবার ঢাকা মহানগর দক্ষিণসহ ২১ জেলা ও মহানগর, ২৬শে মে শুক্রবার ঢাকা মহানগর উত্তরসহ ১৯ জেলা এবং ২৭শে মে শনিবার ঢাকা মহানগর দক্ষিণসহ ১৫ জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।