জাতীয় কবি : জাতির অভিপ্রায়

জাতীয় কবি : জাতির অভিপ্রায়
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি কিনা এ প্রসঙ্গে কিছুদিন ধরে কতিপয় পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তি নোখ্তা দেওয়া শুরু করেছেন। প্রসঙ্গটি উঠলেই তারা একটা প্রশ্ন জুড়ে দেন, উনাকে জাতীয় কবি ঘোষণার ব্যাপারটা গেজেট নোটিফিকেশন করা হয়নি। কী সর্বনাশের কথা! এতো বড় ভুল!! এতে অনেকে বিভান্ত হচ্ছেন। এ বিভ্রান্তি নিরসন করতে এ সম্পর্কে কিছু লিখা প্রয়োজন মনে করছি। নজরুলের মতন কবিকে নিয়ে গেজেট ফেজেট বিষয়ক বিতর্ক তোলাটাকেই আমি অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয় ও ফালতু বলে মনে করি। এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কিংবা নজরুলকে বিতর্কিত ও ছোট করার উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। আবার কেউ কেউ না-বুঝেই অনাবশ্যক এ বিতর্ককে আমলে নিতে পারে।
নজরুলকে একটি বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত করার ব্যাপারটা কি কোনও একটা সরকারি বিজ্ঞপ্তি বা প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা বা না-করার ওপর নির্ভর করে? ঔপনিবেশিক আমলে বৃটিশ সরকারের অভিযোগের ভিত্তিতে অনুগত আদালত কবিকে অপরাধী সাব্যস্ত করে জেল দিয়েছে, তাতে কি দেশবাসী তাকে অপরাধী বলে মেনেছে? পাকিস্তান আমলে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভারতীয় নাগরিক ছিলেন। এ দেশে তাঁর দৈহিক উপস্থিতি ও নাগরিকত্ব না থাকলেও তিনি জনগণের হৃদয়ের মণিকোঠায় ছিলেন। দেশবাসীর এ ভালোবাসার কারণেই পাকিস্তান সরকারও রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে তাঁর নামে অর্থ বরাদ্দ ও সে অর্থ নিয়মিত কোলকাতায় পাঠাতে বাধ্য হয়েছে। তিনি ভারতীয় হওয়া সত্বেও পাকিস্তান আমলে নজরুলের 'চল চল চল' গানটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কুচকাওয়াজ সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। কেননা নজরুল ভারতীয় ও ভারতে থাকতেও আমাদের ছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায় তাই লিখেছিলেন : "ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল।"
মানুষের এ ভালোবাসার কারণেই শেখ সাহেব স্বাধীনতার পর অসুস্থ কবিকে এদেশে আনেন এবং তাঁর আবাসন, চিকিৎসা সহ যাবতীয় ব্যয়ভার রাষ্ট্র গ্রহন করে। জিয়াউর রহমানের সরকার কবি নজরুলকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান এবং জাতীয় কবি ঘোষণা করে। সরকারের কেবিনেটের এ সিদ্ধান্ত প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করে জনগণকে অবহিত করা হয়েছিল কিনা এবং রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী আদৌ এটা করা অপরিহার্য ছিল কিনা, সেটা ইতিহাসের অতলে ডুবুরি নামিয়ে খুঁজতে যাওয়াটা আমার মতে, একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। দেশবাসী এবং সমগ্র জাতি কবি নজরুলকে অবিসংবাদিতভাবেই জাতীয় কবি বলে মেনে নিয়েছে, এটাই অকাট্য সত্য ও বাস্তবতা।
জনগণের আকাঙ্ক্ষা, অনুভূতি ও অভিপ্রায়কে মর্যাদা দেয়াটাই রাষ্ট্রের কর্তব্য। রাষ্ট্রের নির্বাহী হিসেবে সরকার সে কর্তব্য বাস্তবায়ন করে। যদি তা' না করে সেটাই সরকারের অন্যায় ও গণবিরোধী ভূমিকা।
বিভিন্ন সরকার জাতীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান জানাতে নজরুলকে মর্যাদা দেয়ার যে-সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার কোনোটাতেই বিজ্ঞপ্তি জারির প্রয়োজন পড়েনি। এসব সিদ্ধান্তের কোনোটায় আইনি কোনও শর্ত পূরণে ত্রুটি ছিল কিনা সে তর্কও এতোদিনে অপ্রাসঙ্গিক। জনগণের সন্মিলিত অভিপ্রায় ও অনুভূতি কোনও সরকারি প্রজ্ঞাপন মেনে চলে না। জনগণের কাছে গ্রহনযোগ্যতার প্রশ্নে কতো সরকারী প্রজ্ঞাপনই তো ইতিহাসের ধোপে টেকেনি। আবার বিনা প্রজ্ঞাপনেই কতো কিছু এদেশে ইতিহাসের অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে, এর জন্য কি কোনও গেজেট নোটিফিকেশনের দরকার ছিল? গেজেট না হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে? না, বাস্তব পরিস্থিতি ও জনগণের মান্যতাই স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। এটা রদ, রহিত করা যেমন সম্ভব নয়, নজরুল আমাদের জাতীয় কবি - এই বাস্তবতাও তেমনই অকাট্য।◾
পুনশ্চঃ
******
আমি এখন দেশের বাইরে থাকায় আমার হাতে কোনও কাগজ নেই, পুরানা কাগজ খোঁজা বা ঘাঁটাঘাঁটি করারও উপায় নেই কোনও। তবে স্মৃতি ঘেঁটে বলছি, কোনও একটা সময়ে, সম্ভবতঃ ১৯৭৬ সালেই, নজরুল বাংলাদেশের 'জাতীয় কবি' বলে মন্ত্রিসভা বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এটা না করলেও অসুবিধা কিছু হতো না। মানুষের অন্তরে, মুখে মুখে ও ইতিহাসে তিনি জাতীয় কবির মর্যাদাই পেতেন। তাছাড়া, বাংলাদেশ সরকারই পরবর্তীকালে 'জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়' স্থাপন করে। এটাও রাষ্ট্র ও সরকারের তরফে একটা স্বীকৃতি। নজরুল সরকারের ঘোষিত, সনদপ্রাপ্ত বা নিবন্ধনকৃত জাতীয় কবি কিনা সেই প্রশ্নকেই আমি অবান্তর মনে করি। জাতীয় কবি কোনও রাষ্ট্রীয় বা সরকারি পদ-পদবি, সনদ, খেতাব, পদক, পুরস্কার বা ভূষণ নয়। এর জন্য গেজেট বা প্রজ্ঞাপন লাগবে - এমন কোনও আইনও নেই। এটা জাতীয়ভাবে জনগণের ভালোবাসার স্বীকৃতি। এগুলোর জন্য কোনও প্রজ্ঞাপন বা বিজ্ঞপ্তি লাগেনা।
শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা কখনও কোনো গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে ঘোষণা করা হয়নি। তবুও এসব মেনে চলা অনেকের কাছেই 'ঈমানী দায়িত্ব' সমতুল্য। কোনও প্রজ্ঞাপন এবং সরকারি ঘোষণা বা অনুমোদন ছাড়াই রবীন্দ্রনাথ কবিগুরু বা বিশ্বকবি, ভাসানী মজলুম জননেতা, জসিমউদদীন পল্লীকবি এবং জয়নুল আবেদীন শিল্পাচার্য। এঁদের এসব পরিচিতি রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষেও উপেক্ষা করা সম্ভব না হওয়ায় স্বীকার করে নিতে হয়েছে। নজরুলও তেমনই বিদ্রোহী কবি এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষে তা অস্বীকার করার সুযোগ নাই বরং বিভিন্ন পন্থায় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিই দিতে হয়েছে।◾
মারুফ কামাল খান, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট ; সাবেক প্রেস সচিব, বিএনপি চেয়ারপারসন  (ফেইসবুক ওয়াল থেকে)।