কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল: তিন কারণে বাড়ছে অপেক্ষা 

দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে সংযোগপথের জটিল কাজও সম্পন্ন হয় গত বছরের অক্টোবরে।

কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল: তিন কারণে বাড়ছে অপেক্ষা 

প্রথম নিউজ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম যোগাযোগ পথ—টানেলের দুটি সুড়ঙ্গের (টিউব) খননকাজ শেষ হয়েছিল দেড় বছর আগেই। দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে সংযোগপথের জটিল কাজও সম্পন্ন হয় গত বছরের অক্টোবরে। প্রকল্পের এই অগ্রগতির কারণে গত বছরের ডিসেম্বরেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টানেলের ভেতর দিয়ে যান চলাচলের আশা তৈরি হয়েছিল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

মেয়াদের শেষ মুহূর্তে এসে নিরাপত্তার কারণে টানেলের দুই প্রান্তে স্ক্যানার বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। যাতে টানেলের ভেতরে প্রবেশের আগেই গাড়িগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। এ ছাড়া নতুন করে টানেলের দুই প্রান্তে দুটি পুলিশ ফাঁড়ি ও দুটি ফায়ার স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। নিরাপত্তা–সংক্রান্ত নতুন এ তিন কাজ প্রকল্পের শুরুতে ছিল না। পরে এক এক করে যুক্ত হয়। ফলে এসব কাজ সম্পন্ন করতে টানেলের ভেতর দিয়ে যান চলাচলের অপেক্ষাও বাড়ছে। 

এপ্রিল পর্যন্ত টানেলের ৯৭ দশমিক ২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। টানেল কবে চালু হবে, তা সরকারের উচ্চপর্যায় নির্ধারণ করবে।  টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, এপ্রিল পর্যন্ত টানেলের ৯৭ দশমিক ২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। টানেল কবে চালু হবে, তা সরকারের উচ্চপর্যায় নির্ধারণ করবে। 

গত বছরের ডিসেম্বরেই ছিল প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্ধারিত মেয়াদ। এর কয়েক মাস আগেই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, গত বছরের নভেম্বরেই যান চলাচলের জন্য টানেল খুলে দেওয়ার। তবে তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি করে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এর সঙ্গে ব্যয় বেড়েছে ৩১৫ কোটি টাকা। এ অবস্থায় নতুন করে টানেলের ভেতর দিয়ে যান চলাচলের নতুন সময়সূচি ঘোষণা করেছেন সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সম্প্রতি তিনি গণমাধ্যমকে জানান, আগামী সেপ্টেম্বরে খুলছে টানেলের দ্বার।

দেশের প্রথম টানেলের নামকরণ করা হয়  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে চীনের চায়না কমিউনিকেশনস, কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসিএল) লিমিটেড। নির্মাণে এখন ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিরাপত্তার স্বার্থে টানেলের দুই প্রান্তে আটটি স্ক্যানার বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অবশ্য প্রাথমিকভাবে চারটি স্ক্যানার বসানো হবে। এ জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে। স্ক্যানারগুলো এখনো দেশে আসেনি।
নিরাপত্তার তিন কাজ: ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্মাণকাজ শুরুর আড়াই বছর পর ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উভয় প্রান্তে ট্রাফিক রুট নির্মাণসংক্রান্ত গঠিত কমিটির’ এক সভায় টানেলের সার্বিক নিরাপত্তা ও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতার জন্য দুটি ফাঁড়ি নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়। একই সভায় টানেলের অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপনের আলোচনা হয়েছিল। এরপর গত বছরের ৩ মার্চ কমিটির দেওয়া এক প্রতিবেদনে পুলিশ ফাঁড়ি ও ফায়ার স্টেশন নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে টানেলের দুই প্রান্তে স্ক্যানার বসানোর সিদ্ধান্ত হয়।তবে বিভিন্ন সময় পৃথকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এসব কাজ যুক্ত হয়ে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) অনুমোদন পায় চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি।

প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিরাপত্তার স্বার্থে টানেলের দুই প্রান্তে আটটি স্ক্যানার বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অবশ্য প্রাথমিকভাবে চারটি স্ক্যানার বসানো হবে। এ জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে। স্ক্যানারগুলো এখনো দেশে আসেনি। তবে স্ক্যানার বসানোর জন্য লেন নির্মাণের কাজ চলছে। অবশ্য উদ্বোধনের আগেই স্ক্যানার স্থাপনের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আর টানেলের দুই প্রান্তে পুলিশ ফাঁড়ি ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের নির্মাণকাজ কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে। 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ সুড়ঙ্গের পূর্তকাজ শেষ হয়েছে
টানেলের নির্মাণকাজে যুক্ত এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল বুধবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, টানেলের সিভিল ওয়ার্কস বা পূর্ত কাজ শেষ হয়েছে। সেতু বা রাস্তা হলে এই পর্যায়ে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যেত। কিন্তু টানেল সেতু বা রাস্তার মতো নয়। যান চলাচলের আগে এটি সম্পূর্ণভাবে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এখন সেই প্রক্রিয়া চলছে। 

প্রয়োজনীয় সব কাজ যদি শুরুতে বিবেচনায় না নেওয়া হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত হবে বলে মন্তব্য করেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরে শুনে আসছি, টানেল উদ্বোধন হবে। কিন্তু এখনো হয়নি। এর মধ্যে শেষমুহূর্তে এসে আবার পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণ ও স্ক্যানার স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে। এসব আগেই ভাবার দরকার ছিল। এখন যত দ্রুত সম্ভব এসব কাজ শেষ করতে হবে। চট্টগ্রামের মানুষ টানেল উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে।’