অভয়নগরে মতুয়া সম্প্রদায়ের ১৮ বাড়িতে আগুন-ভাঙচুর-লুটপাট, কী ঘটেছিল সেখানে

প্রথম নিউজ, অনলাইন: যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহরমসিয়াহাটি গ্রামের বাড়েদাপাড়ায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী মতুয়া সম্প্রদায়ের একটি গ্রামে ধর্মীয় একটি উৎসব চলার মধ্যে গত বৃহস্পতিবার হামলা করে ১৮টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ও ভাঙচুর, লুটপাট করা হয়েছে। বিএনপির স্থানীয় একজন নেতার হত্যাকাণ্ড কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভবদহ অঞ্চলের বিলের মধ্যেই অবস্থিত এ গ্রামটিতে সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বসবাস করেন, যাদের বেশিরভাগই মতুয়া সম্প্রদায়ের। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই উপজেলারই নওয়া পাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি তরিকুল ইসলাম সরদার গ্রামটিতে নিহত হন।
ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এই হামলা, লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
পুলিশ, সাংবাদিক ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেদিন মতুয়া সম্প্রদায়ের বাৎসরিক যজ্ঞ উপলক্ষে প্রায় পাঁচ থেকে ছয়শো মানুষের খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। এর মধ্যেই হামলা ঘটনা ঘটে। আগুনে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে জ্বলে পুড়েছে এ গ্রামের বাড়িগুলো।
এখনো গ্রামে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ।
তবে তিনদিন পার হতে চললেও এখন পর্যন্ত ওই হত্যাকাণ্ড এবং হামলার ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আব্দুল আলীম। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের পরিবারও এখনো মামলা দায়ের করেনি।
পুলিশের পক্ষ থেকেও হামলার ঘটনায় কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি।
কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এ বিষয়ে এখনো তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
যদিও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন ভালো আছে বলে দাবি অভয়নগর থানার ওসির। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে পুলিশ দাবি করেছে।
ঘটনার সূত্রপাত কিভাবে?
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি তরিকুল ইসলাম সরদারের সঙ্গে বাড়েদা পাড়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন ব্যক্তির মাছের ঘেরের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল।
যশোরের ওই ভবদহ দীর্ঘদিন ধরেই জলাবদ্ধ এলাকা। সেখানেই তাদের দুজনের যৌথভাবে এই মাছের ঘের ছিল। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ওই মাছের ঘেরের ইজারা নিতে চান নিহত তরিকুল ইসলাম সরদার। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
স্থানীয় সাংবাদিক সাজেদ রহমান বকুল জানান, ‘যেদিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ওইদিন ওই ব্যক্তি তরিকুলকে মাছের ঘের লিখে দেওয়ার কথা জানায়। তরিকুলকে ডিড (চুক্তিপত্র) করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে।’
নিহত তরিকুল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আগে বাড়েদা পাড়ায় যান। একপর্যায়ে সন্ধ্যায় ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মাছের ঘেরকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং এরপর ওই অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাংচুর হয় বলে জানিয়েছেন অভয়নগর থানার ওসিও। তরিকুল ইসলামের হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তার সমর্থকরা ওই বাড়েদা পাড়ার বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। একইসঙ্গে চলে লুটপাট ও ভাঙচুর।
ভুক্তভোগীরা যা বলছেন
বাড়েদা পাড়ার যে বাড়িতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেই বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া অন্য বাড়িগুলো থেকে বেশ কিছুটা দূরে হলেও পরেও সেসব বাড়িতেও হামলা চালানো হয়। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যে সময়ে পৌর কৃষক দল সভাপতি তরিকুল ইসলাম নিহত হন সে সময় পার্শ্ববর্তী বাড়িতে চলছিলে মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বাৎসরিক যজ্ঞ উৎসব।
তিন দিনব্যাপী এই উৎসব বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত চলার কথা ছিল। যজ্ঞ উপলক্ষে পাঁচ থেকে ছয়শো মানুষের খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল সেদিন। ওই গ্রামেরই বাসিন্দা মানব বিশ্বাসের বাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, করা হয়েছে লুটপাট ও ভাঙচুর।
মানব বিশ্বাস বলেন, এক লাখ টাকার উপরে ক্যাশ নিয়েছে, সোনার চেইন নিয়েছে একটা। টিভি, ফ্রিজ ভাঙচুর করেছে। এগুলো একদম অকেজো হয়ে গেছে। আলমারি, ড্রেসিং টেবিলও ভাঙচুর করেছে। আমার বসতবাড়িতে এরপর আগুন দেয়।
তিনি জানান, ওইদিন যজ্ঞের কারণে মাইকের শব্দ এবং ঢাকের আওয়াজের কারণে কেউ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বুঝতে পারেনি। পরে যখন ওই পাড়া থেকে দুই – একজন নারী দৌঁড়ে আসে তখন সবাই হত্যার কথা জানতে পারে। কিন্তু এরই মধ্যে শত শত মানুষ গ্রামে হামলা চালাতে শুরু করে।
তবে প্রথমে গ্রামবাসী নিজেদের বাড়িতে থাকলেও আগুন দেওয়া শুরু হলে জীবন বাঁচাতে বিলের আশেপাশের মাঠে গিয়ে আশ্রয় নেয়। মানব বিশ্বাস জানান, ‘পাঁচ - ছয়শো লোকের জন্য রান্না চলছিল। প্রথম হামলা ওরা ওইখানে চালায়। রান্নার কড়াই সব উল্টে ফেলে দেয়। নারী থেকে শুরু করে বয়স্ক লোক সবাইকে মারধর শুরু করে।’
পুলিশ যা বলছে
পৌর কৃষক দল সভাপতি তরিকুল ইসলাম সরদারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাড়েদাপাড়ায় বাড়িঘরে আগুন দেয়ার ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে হয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। তবে এ ঘটনা রাজনৈতিক কোনো ঘটনা নয় বলে দাবি পুলিশের।
অভয়নগর থানার ওসি আব্দুল আলীম বলেন, ‘এটা রাজনৈতিক কোনো সহিংসতা না। ওইখানে পাশেই মাছের একটা ঘের আছে। ওই মৎস্য ঘেরের জের ধরে ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। অন্তত ১৫ থেকে ২০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।’
এখন পর্যন্ত ওই ঘটনা সম্পর্কে কেউ কোনো অভিযোগ থানায় দেয়নি বলে জানিয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তবে পুলিশ আইনগত প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, বলে দাবি করে আব্দুল আলীম।
পুলিশ মামলা করবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আইনের যে বিধিবিধান রয়েছে সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব। তদন্ত সাপেক্ষে আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাব।’
কৃষক দলের সন্দেহ রাজনৈতিক পূর্ব শত্রুতার
প্রাথমিকভাবে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে এ হত্যাকাণ্ড মনে করলেও রাজনৈতিক কারণে এ হত্যাকাণ্ড কীনা সেটি খতিয়ে দেখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আহ্বান জানিয়েছেন যশোর জেলা কৃষক দলের সভাপতি অধ্যাপক মকবুল হোসেন।
মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে এটা ব্যবসায়িক মনে করেছি। কিন্তু যেহেতু তরিকুলের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ আমলের ১৭টা মামলা রয়েছে। সেই কারণে ব্যবসায়িক বিষয়কে ইস্যু করে তৃতীয় পক্ষ পেছন থেকে রাজনৈতিকভাবে কাজ করেছে কীনা সেটা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিষয়টার তদন্ত করে দেখা হোক।’
কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা হিন্দুদের বাড়ি - ঘরে আগুন ও লুটপাট চালিয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, এমন প্রশ্নে মকবুল বলেন, ‘একটা মানুষ যখন হত্যা হয় তখন উত্তেজিত জনতা কে কোন দিক থেকে কী করেছে এটা বোঝা মুশকিল। তবে দুই-একটা ঘরে আগুন দেওয়ার কথা আমরা শুনেছি।’
নিহত তরিকুলকে গুলি করার পরেও কোপানো হয়েছিল এবং তার শরীরে ৩৪টি কোপানোর দাগ ছিল। আর হত্যাকাণ্ডের এই নৃশংসতার কারণেই মানুষ উত্তেজিত হয়ে অগ্নিসংযোগ চালিয়েছে বলে দাবি করেন মকবুল। তবে পরে খুলনা বিভাগীয় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এ ঘটনা জানার পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
মতুয়া সম্প্রদায়ের যজ্ঞ উৎসবের স্থানে নয় বরং শুধুমাত্র যে বাড়িতে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সেই বাড়িতেই অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে বলে দাবি করেন মকবুল। যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা অপরিচিত হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে সত্যিকারের হত্যাকারীদের চিহ্নিত করতে পারে সেজন্য পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো মামলা দায়ের করতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কয়েক মাসে ভারতের সঙ্গে এই ইস্যুতে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। বাংলাদেশের সরকার বারবারই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। এমন প্রেক্ষাপটে যশোরের অভয়নগরের ঘটনা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে কীনা এমন সম্ভাবনা নাকচ করে দেন যশোর জেলার পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি দীপঙ্কর দাস রতন।
দীপঙ্কর দাস রতন বলেন, ‘সবচেয়ে সমস্যাটা হচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থা এখনও মেরামত শেষ হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই অন্ধকার হয়ে আসলে ওরাতো ট্রমাটাইজড, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আছে। সেজন্য প্রবলেম হচ্ছে, ঘরে ফেরার সাহস পাচ্ছে না। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে।’
সূত্র : বিবিসি বাংলা।