অনলাইনে সক্রিয় জঙ্গিরা: মাথাচাড়া ঠেকাতে জোরদার সাইবার মনিটরিং
গোয়েন্দা তথ্যসহ নানা মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেসব বিষয় শনাক্ত করে জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অনলাইনকেন্দ্রিক জঙ্গিদের তৎপরতা থাকলেও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার কোনও সুযোগ নেই বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। যদিও অনলাইনে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন সদস্য সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহে সক্রিয় রয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যসহ নানা মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেসব বিষয় শনাক্ত করে জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। সম্প্রতি নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফীল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামীন মাহফুজকে তার স্ত্রীসহ গ্রেফতার করা হয়। সংগঠনটি মূলত টার্গেটকেন্দ্রিক বিভিন্ন নাশকতার পরিকল্পনার লক্ষ্য নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল। এরই মধ্যে নাশকতার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এসব বিষয় নিয়ে কাজ করছেন তারা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা কোথায় কী ধরনের হামলা চালাবে এসব বিষয় সম্পর্কে সংগঠনের সব সদস্য ওয়াকিবহাল থাকে না। কখন হামলা চালাতে হবে কিংবা কোথায় হামলা চালাতে হবে তা আগে থেকেও কিছু বলা হয় না। আর সবচেয়ে বড় বিষয় বলে কয়ে জঙ্গি হামলা চালানোর মতো সক্ষমতা জঙ্গি সংগঠনগুলোর বর্তমান প্রেক্ষাপটে নেই।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, সম্প্রতি জামাতুল আনসার ফীল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজকে গ্রেফতারের পর নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে সংগঠনটি। সবকিছু শামিন মাহফুজ তদারকি করতো, তার কথামতোই সংগঠনটি পরিচালিত হতো। পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়া তরুণরা যারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে, গ্রেফতারের আগে কোনও নির্দেশনা দিয়েছে কিনা এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যও পাওয়া গেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পাহাড়ের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয় এই সংগঠনের সদস্যরা। সবচেয়ে বড় আতঙ্কের বিষয় এই প্রশিক্ষণের মধ্যে অনেকেই আইটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষতা অর্জন করেছে। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে তাদেরকে শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। তা না হলে এক ধরনের আতঙ্ক থেকে যায়।
জঙ্গি নিয়ে কাজ করা একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ২০০৪-২০০৫ সালে জঙ্গিবাদের যে উত্থান হয়েছিল তারা অনেকেই আফগান ফেরত ছিল। উগ্রবাদে একবার জড়িয়ে পড়লে তা থেকে ফিরে আসা অনেকটাই কষ্টসাধ্য। একজন জঙ্গি বা উগ্রবাদীর যে আচরণগত চিন্তা চেতনা বা কার্যকলাপ তা একজন সাধারণ মানুষের স্ট্রাটেজির মধ্যে পড়ে না। চিন্তা চেতনা কার্যক্রম সিরিয়াস ড্যামেজ। এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণার প্রয়োজন। গবেষণা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ কিংবা যেকোনও জঙ্গি আইনের আওতায় আনার পর তাদেরকে মোটিভেশন বা ডি রেডিকালাইজড করতে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।
১৯৯২ সালে আফগান যুদ্ধ ফেরত আব্দুস সালাম জঙ্গিদের একত্রিত করার চেষ্টা শুরু করে। পরবর্তীতে এর হাল ধরে মুফতি হান্নান। মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে হরকাতুল জিহাদের সৃষ্টি। আর যারা সে সংগঠনে যুক্ত ছিল তারা সবাই আফগান যুদ্ধ ফেরত সশস্ত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য। এই হরকাতুল জিহাদের মাধ্যমেই দেশে প্রথম জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদিচির অনুষ্ঠানে হামলা চালালে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের তৎপরতার বিষয়টি সামনে আসে। পরবর্তীতে ২০০১ সালে রমনা বটমূলে হামলা, ২০০৪ সালে সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর হামলা, ২০০৪ এ একুশে আগস্ট বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় বোমা হামলা।
এক পর্যায়ে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানের ওপর যারা ভরসা করতে পারছিল না, তারা কাশ্মীর ফেরত এবং পাকিস্তানের লাসকারী তাইয়্যেবা প্রশিক্ষিত শায়খ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ নামে আরেক সংগঠনের সৃষ্টি করে। ১৯৯৮ সালে এর সৃষ্টি হয়। ২০০৫ সালে সারা দেশে ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে তারা নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়।
বাংলাদেশ পুলিশ তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রথম এবং দ্বিতীয় জেনারেশনের সন্ত্রাসীদেরকে মোটামুটি নির্মূল করতে সক্ষম হয় প্রচলিত বিচারের মাধ্যমে। তারপর মোটামুটি কয়েক বছর ভালোভাবেই কাটে। কিন্তু এই সংগঠনের যারা দলছুট তারা আবার ২০১২ সালে সংঘটিত হওয়ার চেষ্টা করে। আনসার আল ইসলাম ও নিও জেএমবি নামে দুটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। যারা ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটায়। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময় তারা বিচ্ছিন্নভাবে ব্লগার, ভিন্ন মতাদর্শ, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ ভিনদেশিদের টার্গেট করে।
এ প্রসঙ্গে এন্টি টেরোরিজম ইউনিট এটিইউ এর প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি রুহুল আমিন বলেন, ২০১৬ সালে গুলশানে হোলি আর্টিজানে হামলার ঘটনার আগে জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশের তেমন দক্ষতা ছিল না। ২০০৯ সালে পুলিশ ব্যুরো অব কাউন্টার টেরোরিজম নামে একটি ইউনিট গঠনের কার্যক্রম চলমান থাকলেও তা ভেস্তে যায়। এছাড়া জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠা করা হয় র্যাব। পরবর্তী সময়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট নামে একটি ইউনিটের মাধ্যমে জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। ২০১৭ সালে জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে নতুন ইউনিট-এন্টি টেরোরিজম ইউনিট গঠন করা হয়। জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে এন্টি টেরোরিজম ইউনিট হাড এবং সফট এপ্রোচে কাজ করে যাচ্ছে। বিট পুলিশ ও কমিউনিটি পুলিশকেও এটিইউয়ের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে।
তিনি বলেন, জঙ্গিরা বসে নেই। সাম্প্রতিক সময় দেখা যাচ্ছে তারা অনলাইনে অ্যাকটিভ রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নতুন সদস্য সংগ্রহ, সমর্থক সংগ্রহ করতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা। এটিইউ এর অনলাইনে পেট্রলিংয়ে মাধ্যমে এসব বিষয় আমরা দেখতে পাচ্ছি। পেট্রলিং এর মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো আরও ভয়াবহ।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে র্যাবের সাফল্য রয়েছে। তবে সংস্থাটি কোনও আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে না। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। জঙ্গিবাদ মাথচাড়া দিয়ে ওঠার কোনও সুযোগ নেই। সাইবার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে জঙ্গিদের কার্যক্রমেও নজরদারি রাখা হচ্ছে।