অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করা সেই প্রতিবেদন প্রত্যাহার ব্রিটিশ এমপিদের

অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করা সেই প্রতিবেদন প্রত্যাহার ব্রিটিশ এমপিদের

প্রথম নিউজ, ঢাকা : বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে যুক্তরাজ্যের একদল এমপির দেওয়া প্রতিবেদনটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ নিয়ে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠার পর এই পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা। গতকাল রবিবার (১৯ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান।

যুক্তরাজ্যের কমনওয়েলথবিষয়ক অল–পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ (এএপিজি) গত নভেম্বরে ওই প্রতিবেদন দেয়।
তাতে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করা হয়। ওই প্রতিবেদনে উল্লিখিত অনেক তথ্য সঠিক নয় বলে অভিযোগ উঠেছে।

সেখানে অভিযোগ করা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক ও সাবেক কর্মকর্তাদের দমন করতে দেশের আইন ব্যবস্থাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এর পাশাপাশি ইসলামি উগ্রপন্থিদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবও তুলে ধরা হয় তাতে।

ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের বরাতে রবিবার গার্ডিয়ান লিখেছে, প্রতিবেদনটি আর বিতরণ করা হচ্ছে না। লেবার পার্টির একজন এমপি হাউস কমন্সে অভিযোগ জানানোর পর এটি ‘পর্যালোচনা’ করে দেখা হচ্ছে। তবে সেই প্রতিবেদন কবে প্রত্যাহার করা হয়েছে গার্ডিয়ানের রোববারের খবরে তা বলা হয়নি।

এপিপিজির এক মুখপাত্র গার্ডিয়ানকে বলেন, এটি একটি প্রশ্নবিদ্ধ প্রতিবেদন।
এটি বর্তমানে পর্যালোচনাধীন একটি অভ্যন্তরীণ নথি। বৃহৎ পরিসরে আলোচনার অংশ হিসেবে বিষয়টি পররাষ্ট্র দপ্তরকেও জানানো হয়েছে। এটি বাইরে প্রকাশ করা হবে না এবং এই বিষয়ে এপিপিজি কোনো ফলোআপও করবে না।

গার্ডিয়ান লিখেছে, শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সম্পৃক্ততার অভিযোগে তীব্র সমালোচনার মুখে ব্রিটেনের আর্থিক সেবা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে অভিযোগ উঠেছে, ব্রিটিশ রাজনীতিতেও আওয়ামী লীগ হস্তক্ষেপ করছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ‘বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি’ শিরোনামে এপিপিজির প্রতিবেদনটি সংবাদমাধ্যমে আসে গত নভেম্বরে; শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রায় তিন মাসে পরে। ক্ষমতায় থাকতে শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর সহিংসতা চালান। এতে প্রায় এক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।

প্রতিবেদনটিতে মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ‘একগুচ্ছ’ সমালোচনা করা হয়। ওই সময় প্রতিবেদনের সঙ্গে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন এপিপিজির সভাপতি ও কনজারভেটিভ পার্টির নেতা অ্যান্ড্রু রোসিনডেল। সেখানে তিনি বলেছিলেন, শুধু বর্তমান সরকারের সমর্থনকারীকে নয়, বাংলাদেশের উচিত দেশের সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়া। শিগগিরই এই পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটলে নতুন সরকারের আন্তর্জাতিক সমর্থন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।

এপিপিজির প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছিল, ইউনূস সরকার আইনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এবং কট্টর ইসলামপন্থিদের ক্ষমতায়ন ঘটাচ্ছে।

প্রতিবেদনটির বিষয়ে গার্ডিয়ান লিখেছে, প্রতিবেদনটি তারা মূলত পেয়েছে দিল্লিভিত্তিক থিংক ট্রাংক ‘রাইটস অ্যান্ড রিস্ক অ্যানালাইসিস গ্রুপের’ মাধ্যমে।

এতে ব্রিটিশ এমপিরা বলেন, আমরা তথ্যপ্রমাণ পাচ্ছি যে, বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগের নেতা, সাবেক বিচারক, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এত এত মামলা দেওয়া হচ্ছে, যা বর্তমান সরকারের গ্রহণযোগ্যতে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

যদিও এর সমালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিহত আন্দোলনকারীর সংখ্যা প্রতিবেদনে কম দেখানো হয়েছে এবং বেশির ভাগ মৃত্যু শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরে ঘটেছে বলে এতে তুলে ধরা হয়।

এপিপিজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বেশিরভাগ মৃত্যুই ঘটে ৫ আগস্টের পরে, যখন পুলিশের সহিংসতার বিরুদ্ধে এবং গত সরকারের সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে লাখ লাখ মানুষ রাজপথে পথে নেমে আসে।

গার্ডিয়ান লিখেছে, এই তথ্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনের সাংঘর্ষিক। গত আগস্টে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়— হতাহতের বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগের হাতে।

এপিপিজির প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশের নতুন সরকার এক লাখ ৯৪ হাজার মানুষকে অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের কাছে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হয়েছে, এই সংখ্যা সম্ভবত তাদেরকে বোঝানো হয়েছে। এটা অভিযুক্তের সংখ্যা নয়।

গার্ডিয়ানের রবিবারের প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে আসা লেবার পার্টির এমপি রুপা হক এপিপিজির প্রতিবেদনের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, এতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। রুপা হক দাবি করেন, ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে প্রতিবেদনের প্রসঙ্গটি তোলেন এবং জিজ্ঞাসা করেন, আপনার সরকার এগুলো কী করছে, পার্লামেন্টের নামে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।

লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিসের অধ্যাপক নাওমি হোসাইন গার্ডিয়ানকে বলেন, প্রতিবেদনে বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে ন্যূনতম যাদের জ্ঞান আছে, তারা এগুলো ধরে ফেলবে। এটা হয় পক্ষপাতদুষ্ট, নয়ত খুবই দুর্বল একটি বিশ্লেষণ।

এপিপিজির এক মুখপাত্র গার্ডিয়ানকে বলেন, গ্রুপটি এখন থেকে কোনো নির্দিষ্ট দেশ নিয়ে প্রতিবেদন দেবে না। এর পরিবর্তে তারা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমনওয়েলভুক্ত দেশগুলোর দিকে মনোযোগ দেবে।