অন্তিম অবস্থায় সরকার পতন অত্যাসন্ন: রিজভী
সোমবার (৩০ অক্টোবর) বিকেলে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: আদর্শ ও ন্যায়ের সংগ্রাম কখনো পরাজিত হয় না মন্তব্য করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘চক্রান্তকারী নিষ্ঠুর আওয়ামী সরকারের পতন অত্যাসন্ন। গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে চলমান আন্দোলন, মামলা, হামলা ও গ্রেফতার দিয়ে কখনোই থামানো যাবে না।
তিনি বলেন, ‘গতপরশু ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে বর্তমানের কর্তৃত্ববাদী সরকারের বংশবদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী যৌথভাবে যে হিংস্র পরিকল্পনার মাধ্যমে হামলা, তাণ্ডব, ও জানমালের ক্ষতিসাধন করেছে বিএনপি তাতে ঘৃণা, ক্ষোভ ও ধিক্কার জানাচ্ছে।
সোমবার (৩০ অক্টোবর) বিকেলে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চলমান আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত জুলাই ২০২২ থেকেই লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে বিএনপি পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় সমাবেশ ও ঢাকায় মহাসমাবেশ করেছে। এসব সমাবেশে যে লোক সমাগম হয়েছে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব। পথে পথে বাঁধা অতিক্রম করে দেশের সকল শ্রেণি ও পেশার আপামর জনসাধারণ এসব কর্মসূচিতে শান্তিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। সাধারণ মানুষ বিএনপির দাবির সাথে একাত্মতা জানিয়ে যেভাবে যোগ দিয়েছেন, তা বিএনপিসহ সব গণতান্ত্রিক দলের নেতা-কর্মীকে অনুপ্রাণিত করেছে, তাদের দাবি যে জনগণের দাবি তা প্রমাণ করেছেন। নারী-পুরুষ, তরুণ-বৃদ্ধ, শ্রমিক-কৃষক কেউ বাসে, কেউ ট্রেনে, কেউ পায়ে হেঁটে, নদী সাঁতরে পার হয়ে, চিড়া-মুড়ি সাথে নিয়ে আমাদের সমাবেশগুলোতে যোগ দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে বাঁধা দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ ও তার ফ্যাসিবাদী সরকারের অনুগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী গতপরশু ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ এবং আজ ২৯ অক্টোবরের শান্তিপূর্ণ হরতাল কর্মসূচিতে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহতের সংখ্যা চার (৪) জন, গ্রেপ্তারকৃত নেতা-কর্মীর সংখ্যা ৬৯০ জন, মোট মিথ্যা মামলার সংখ্যা ২০টি এবং আহত ৩ হাজারের অধিক নেতা-কর্মী। এছাড়াও মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ২৩ অক্টোবর হতে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ৫ দিনে মোট গ্রেফতার করা হয়েছে ২৬৪০ জনের অধিক নেতা-কর্মী এবং মিথ্যা মামলা হয়েছে ৪৫টি।
বিএনপির এই মুখপাত্র অভিযোগ করে বলেন, ‘গত ২৮ জুলাই হতে ২৯ অক্টোবর ২০২৩ পর্যন্ত বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারাদেশের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে ৪৪২টি, গ্রেফতার করা হয়েছে ৫৩১০ জন, মোট আসামি ৩১ হাজার ৯৮০ জন, এবং হামলা চালিয়ে আহত করা হয়েছে ৫ হাজার ১১০ জনের চেয়েও বেশি নেতা-কর্মীকে। বিচারবিভাগের রাজনীতিকরণ করে ১৫টি মিথ্যা মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও প্রায় ৯০ জনের অধিক নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। এই পরিসংখ্যান কেবল গত জুলাই থেকে আজ অবধি, গত ১৫ বছরে লাখো মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে, কারাগারে কয়েক লাখ বিএনপি কর্মী অন্তরীন হয়েছে, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের গুলিতে ও নির্যাতনে সন্তান হারিয়েছেন হাজারো বাবা-মা।’
তিনি বলেন, ‘এসব নির্যাতন ও অনিয়মের বিরুদ্ধে যারাই প্রতিবাদ করেছেন, সরকারের সমালোচনা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেই অত্যাচার ও মামলার খড়গ নেমে এসেছে। কুখ্যাত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮-এর কবলে পড়ে অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংবাদিক, সোশ্যাল মিডিয়া এক্টিভিস্ট, কার্টুনিস্ট, লেখক, কলামিস্ট ও সুশীল সমাজের অন্যান্য সদস্যরা অত্যাচারিত হয়েছেন, পুলিশি হেফাজতে ও কারাগারে নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেছেন। গুমঘর আর আয়নাঘরের দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়েছে অসংখ্য বেদনার ইতিহাস, গুমরে মরেছে নানা প্রাণ। বিচার-বহির্ভূত হত্যা আর গুম হয়ে যাওয়া নেতা-কর্মীদের পরিবারের সদস্য আর ছোট্ট অবুঝ সন্তানদের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এসব মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সোচ্চার রয়েছে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে যুক্ত তার স্বপক্ষে সুনির্দিষ্ট প্রমান দাখিল করেছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব বলেন, ‘এই নজিরবিহীন অত্যাচার, নির্যাতন, ও খুনের শিকার হয়েও বিএনপি সহ গণতন্ত্রের পক্ষের দলগুলো সহিংসতার পথ বেছে নেয়নি। নেতা-কর্মীরাও শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলনে স্বত:স্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছেন। বিএনপির গণতন্ত্র পুন:রুদ্ধারের যৌক্তিক দাবির সাথে একমত পোষণ করে গণতন্ত্রের পক্ষের সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এবং ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একত্রে জোর আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। গণতন্ত্রের পক্ষের সব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশগুলো একটি সুষ্ঠু ও অংশীদারিত্বমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছেন। দেশের ভেতরের সাধারণ মানুষ ও বাইরের আন্তর্জাতিক শক্তির জোর সমর্থন পাবার ফলে বিএনপির নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন যখন সফল হতে যাচ্ছে, তখন ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ভীত হয়ে উঠেছে। এই অন্তিম অবস্থায় আওয়ামী লীগ যৌক্তিক জ্ঞান হারিয়ে সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘গত ২৮ অক্টোবরে ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে একটি সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করার পরিকল্পনা করে আওয়ামী লীগ ও তাদের অনুগত রাজনৈতিক পুলিশ বাহিনী। যে বিপুল গণজোয়ার ঢাকার পথে আসতে শুরু করে তা বাঁধা দেবার জন্য তারা সারা দেশব্যাপী ধরপাকড় শুরু করে। ঢাকার প্রবেশপথ গুলোতে পুলিশ চেক-পোস্ট বসিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে মোবাইল চেক করা হয়। বিএনপি নেতা-কর্মী পরিচয় জানলেই নির্বিচারে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় বিভিন্ন আবাসিক হোটেলগুলোতে ও বাড়িতে রাতের গভীরে হামলা চালিয়ে আটক করা হয় হাজারো নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু গ্রেফতার-নির্যাতন সত্ত্বেও আগের রাত থেকেই মহাসমাবেশের স্থান নয়াপল্টন নেতা-কর্মীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে। ’
রিজভী বলেন, ‘সকাল থেকেই খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে লাখো মানুষ নয়া পল্টনে উপস্থিত হয়। সকাল ৯টার মধ্যেই সমাবেশস্থল ছাড়িয়ে আশেপাশের এলাকাগুলো বিএনপির নেতা-কর্মীদের স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে। এত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও এই অভূতপূর্ব জনসমাবেশ ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার ও পুলিশ বাহিনীকে আরো ভীত করে তুলে। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী, কাকরাইল মোড়ের কাছে আওয়ামী লীগের কিছু সন্ত্রাসী বিএনপির শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ বানচাল করে পুলিশী হামলাকে বৈধতা দেবার উদ্দেশ্যে সহিংস আচরণ শুরু করে। আওয়ামী লীগের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সংলগ্ন একটি গেটে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। তারা পুলিশকে লক্ষ করেও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা শুরু করে।
বিএনপির এই শীর্ষনেতা বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে যেখানে পুলিশ বাহিনীর পেশাদারি ও নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখা দরকার, সেখানে পুলিশ নিজেই আক্রমণাত্মক হয়ে মাত্রাতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ করা শুরু করে। যেখানে মূল জনসভার কেউ এই সহিংস ঘটনায় যুক্ত ছিলো না, সেখানে পুলিশ বাহিনী সম্পূর্ণ পূর্ব-পরিকল্পনামাফিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে জনসভায় হামলা শুরু করে। মুহুর্মুহু টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও সাউন্ড গ্রেনেড চার্জ করা হয় নিরীহ ও নিরস্ত্র জনগণের উপর। পুরো কাকরাইল ও নয়াপল্টন এলাকায় যুদ্ধ-পরিস্থিতির মত ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। পুলিশের লাঠি-চার্জ, রাবার-বুলেট নিক্ষেপ ও সাউন্ড গ্রেনেডে শত শত নিরস্ত্র নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনগণ আহত হন। ন্যাক্কারজনক পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই হামলা চালানো হয় সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মীদের গাড়িতে। বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির সফলতা আঁচ করতে পেরে গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তির বিপক্ষে গণমাধ্যম ও বিচারবিভাগকে মুখোমুখি করাতেই এই সহিংসতার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে আওয়ামী লীগ কর্তৃত্ববাদী সরকার ও তাদের পুলিশ বাহিনী।’
তিনি বলেন, ‘দেশবাসী তথা বিশ্ববাসী বিস্ময় ও ক্ষোভের সাথে প্রত্যক্ষ করেছে, গতপরশু ২৮ অক্টোবর শনিবার বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য বিএনপির শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ, যেখানে লক্ষ-লক্ষ মানুষ ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন সেখানে অনির্বাচিত ফ্যাসিস্ট সরকার কি নৃশংস তান্ডব চালিয়েছে! বিএনপির পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে সশস্ত্র হামলা নজিরবিহীন ও ন্যক্কারজনক। কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতা ও পুলিশের বক্তব্যেরই প্রতিফলন এই রক্তাক্ত আক্রমণ। বাস, ট্রেন ও লঞ্চ বন্ধ করেও যখন সরকার মহাসমাবেশ ঠেকাতে পারেনি তারা যখন দেখেছে বাধা উপেক্ষা করে মহাসমাবেশে লক্ষ-লক্ষ লোক যোগ দিয়েছে তখন তারা পরিকল্পিতভাবে ‘মাস্টারপ্ল্যান’ করে, হামলার মাধ্যমে, আমাদের সমাবেশ পণ্ড করে দিয়েছে। বিএনপির মহাসমাবেশ স্থলে আগে থেকেই ইন্টারনেট সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয় আওয়ামী অপশক্তির আজ্ঞাবহ প্রশাসন। বিচ্ছিন্ন করে দেয় বিদ্যুৎ সংযোগ ও বক্তব্য প্রচারের মাইকের লাইন।’
রিজভী আরও বলেন, ‘বিনা উস্কানিতে পুলিশ-র্যাব-বিজিবি, তথা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, একের পর এক টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, লাঠি ও ব্যানেট চার্জ চালাতে থাকে। সরকারের পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সংঘটিত এ যৌথ হামলায় নির্বাচারে আঘাত ও আহত করা হয় বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের।’