৮৩ গডফাদারের নিয়ন্ত্রণে দেশের মাদক ব্যবসা, সহযোগী ১১৮৫

৮৩ গডফাদারের নিয়ন্ত্রণে দেশের মাদক ব্যবসা, সহযোগী ১১৮৫

প্রথম নিউজ, ঢাকা : দেশে বর্তমানে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে ৮৩ জন ‘গডফাদার’। তাদের শীর্ষ পর্যায়ের সহযোগী রয়েছে এক হাজার ১৮৫ জন। তালিকাভুক্ত এসব শীর্ষ ব্যবসায়ী মূলত সীমান্ত ও আকাশপথে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য দেশে আনছেন। গতকাল শনিবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

ডিএনসি সূত্র বলছে, তালিকাভুক্ত মাদকের গডফাদাররা পর্দার আড়ালে থেকে সব সময় এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। সহযোগীদের দিয়ে রাজধানীসহ সারা দেশে সেই মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা। এতে আসক্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ধ্বংস হচ্ছে তরুণসমাজ। এর বাইরে শিশুসহ অনেক পেশাজীবীও এখন মাদকে আসক্ত।

মাদকের অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে এখন ধনীর দুলালরাও ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। এতে সমাজে অপরাধ বাড়ছে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, তালিকাভুক্ত এসব ‘গডফাদারের’ মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তাও আছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসির পরিচালক (গোয়েন্দা অপারেশনস) উপমহাপরিদর্শক তানভীর মমতাজ কালের কণ্ঠকে বলেন, নতুন তালিকা ধরে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করতে দেশে অভিযান চলছে। একই সঙ্গে চেষ্টা চলছে মাদক নিয়ন্ত্রণের।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আড়ালে থাকা এসব গডফাদারের কারণেই মূলত সমাজে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বেসরকারি আহসানউল্লাহ মাদক নিরাময় কেন্দ্রের বর্তমান তথ্য বলছে, সম্প্রতি বিভিন্ন সময়ে তাদের এখানে ৮১৪ নারী মাদকসেবী ভর্তি হয়েছে চিকিৎসার জন্য।
তারা ইয়াবা, হেরোইন, কোকেনসহ অন্যান্য মাদকে আসক্ত।

ডিএনসির প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে (রিহ্যাব) গেছে অন্তত ৫৫ হাজার মাদকসেবী। গত পাঁচ বছরে রিহ্যাবে চিকিৎসা নেওয়া নারী মাদকাসক্ত বেড়েছে পাঁচ গুণ। ১৫ বছর ও তার কম বয়সী মাদকাসক্ত বেড়ে হয়েছে তিন গুণ। সংখ্যায় যা ৪৭ হাজার ৩৭৬।

২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের মামলা, উল্লেখযোগ্য আসামি ও মাদকদ্রব্যের বিবরণের মধ্যে রয়েছে মোট অভিযান আট লাখ ৫৩ হাজার ২৫৮, মামলা হয়েছে দুই লাখ ২৮ হাজার ৭০৯ ও আসামি দুই লাখ ৪৪ হাজার ৮৯৪ জন।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, মাদক ব্যবসায়ীরা দেশ থেকে অর্থও পাচার করছেন। এর  মধ্যে তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারিদের অনেকে দেশ থেকে বিপুল অর্থপাচার করার তথ্য পেয়ে যাচাই করছে তারা। এই তালিকায় থাকা শীর্ষ অন্তত ১০ জন মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচারের তথ্য পাওয়া গেছে।

তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজারের টেকনাফের নুরুল হক ভুট্টো, সিদ্দিক আহমেদ, শফিক আলম ওরফে শফিক, ফজর আলী, নুরুল কবির, চট্টগ্রামের শফি, ঢাকার আদাবরের নুরুল ইসলাম, টঙ্গীর পূর্ব থানার পারুল, খুলনার শাহজাহান হাওলাদার ও পাবনার শাহীন আলম। তাঁদের মধ্যে দুজন গ্রেপ্তারের পর জামিনে রয়েছেন, অন্যরা পলাতক। মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে এর মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের তিন গডফাদারের প্রায় আট কোটি ১১ লাখ টাকা মূল্যের জমি ও বাড়ি জব্দ করা হয়েছে। 

এই তথ্য জানিয়ে গতকাল সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের গচ্ছিত এক কোটি এক লাখ ২৩ হাজার ৪২৫ টাকা জব্দ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৯.১১ একর জমি ও দুটি বাড়ি জব্দ তালিকায় রয়েছে, যার মূল্য আট কোটি ১১ লাখ টাকা। অন্যদের সম্পত্তি ক্রোক করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এই সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে ১৯.৫৩৬ একর জমি, ১১টি বাড়ি ও একটি গাড়ি, যার মূল্য ২৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বাংলাদেশের প্রচলিত মাদক আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এর পরও মাদক ব্যবসা থেমে নেই।

শীর্ষ পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ী : 

উল্লেখযোগ্য মাদক গডফাদারদের বিষয়ে ডিএনসি সূত্র বলছে, ঢাকার সবচেয়ে বেশি শতাধিক শীর্ষ পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৪৫ জন বয়সে তরুণ। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসায়ও এ ধরনের ব্যবসায়ী রয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগে তাঁরা মোট ৭২ জন।

চট্টগ্রাম বিভাগে এসব শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, উখিয়ার সাবেক এমপি, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং তাঁদের আত্মীয়-স্বজন। এর বাইরে রাজশাহী বিভাগে ২১ জন হেরোইন ব্যবসায়ীসহ ৩৫ জনের নাম রয়েছে। এরা রাজশাহী বিভাগের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা। এই বিভাগে শীর্ষ ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও বহনকারী মিলিয়ে এক হাজার ৩৯২ জনের তালিকা রয়েছে। খুলনা বিভাগে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের তালিকায় নাম রয়েছে ২০ জনের। বরিশাল বিভাগে ১৫ জন, সিলেটে ২০ জন, রংপুরে ২৫ জন ও ময়মনসিংহে ২০ জনের নাম জানা গেছে।

ডিএনসি সূত্র বলছে, আগে ইয়াবা চোরাচালানের মূল রুট ছিল মায়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন টেকনাফে। বর্তমানে এই রুটে বিজিবির টহল বাড়ায় চোরাকারবারিরা রুট পরিবর্তন করেছে। সাগরপথে উপকূলীয় এলাকা দিয়ে ঢুকছে ইয়াবা। এ ছাড়া যশোরের বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, চুয়াডাঙ্গা ও জয়পুরহাট সীমান্ত এলাকা দিয়ে ঢুকছে ইয়াবা ও হেরোইন। এ ছাড়া আকাশপথেও মাদক আসার তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে মাদকসহ ধরা পড়েছে একাধিক দেশি-বিদেশি নাগরিক।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, দেশে বর্তমানে হেরোইন, মরফিন, আইস পিলসহ ২৪ ধরনের মাদক বিক্রি হচ্ছে। তবে এর মধ্যে ১১ ধরনের মাদক বেশি ব্যবহার হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে ইয়াবা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে ‘গডফাদারসহ’ এসব শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীকে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সম্প্রতি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ সায়েন্স অ্যান্ড ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, মাদক তরুণ সমাজকে এক কথায় ধ্বংস করে দিচ্ছে। দেশে যেভাবে মাদক ব্যবসা বাড়ছে, তাতে কঠোরভাবে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনা গেলে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।