হাশেম হত্যা মামলায় বিচারিক আদালত পরিবর্তন
প্রথম নিউজ, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় আবুল হাশেম হত্যা মামলায় বিচারিক আদালত পরিবর্তন করা হয়েছে। গত ১৭ জুন জেলা জজ ড. আজিজ আহমেদ ভুঁইয়া আদালত এ আদেশ দেন। বিষয়টি জানাজানি হয় আজ।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়ায় মসজিদে দান করা একখণ্ড জমি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে খুন হওয়া আবুল হাশেম। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের আসামিরা দ্রুত সময়ের মধ্যে জামিন পেয়ে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ ফারজানা আকতারের আদালতে বিচারাধীন মামলার আসামিদের কেউ আত্মসমর্পণের দিন অথবা কেউ গ্রেপ্তারের দিন জামিন পেয়ে যাচ্ছিলেন। এ নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এরপর বাদী পক্ষ মামলাটির সুষ্ঠু বিচার নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে এবং আদালত পরিবর্তনের জন্য জেলা জজ ড. আজিজ আহমেদ ভুঁইয়ার কাছে আবেদন করে।
একই বিষয়ে নিয়ে ঢাকা পোস্টে গত ১৭ মার্চ ‘ভাই হত্যার বিচারে উচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে মুছা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, আসামিপক্ষের এক আইনজীবী এবং বিচারক ফারজানা আকতার দুজনেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ব্যাচের সাবেক ছাত্রী। এছাড়া প্রতিবেদনে এক আসামির জামিনের আদেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেন বাদীপক্ষের আইনজীবীরা।
সবমিলিয়ে বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম আদালতে অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। একপর্যায়ে জেলা জজ আদালত অতিরিক্ত জেলা জজ ফারজানা আকতারের কাছ থেকে বিষয়টির ব্যাখ্যা চান। ব্যাখ্যা পেয়ে মামলাটির সুষ্ঠু বিচারের জন্য অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে স্থানান্তরের আদেশ দেন।
মঙ্গলবার (২৭ জুন) ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা জজ আদালতের পেশকার সাহাবুদ্দিন মো. মোরশেদ।
তিনি বলেন, বাদীপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির বিচারিক আদালত স্থানান্তরিত হয়।
আদালত সূত্র জানায়, হাশেম হত্যা মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন মো. সেলিম। তিনি এজাহার এবং চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়ে দীর্ঘ ৮ বছর পলাতক ছিলেন। বান্দরবান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ২২ ফেব্রুয়ারি আদালতে প্রেরণ করে পুলিশ। মাত্র এক দিনের মাথায় ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে জামিন প্রদান করেন চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ ফারজানা আকতার।
ওই জামিনের আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন, মামলার এফআইআর, এজাহার, জব্দ তালিকা ১৬১ ধারার জবানবন্দীসহ অন্যান্য কাগজাদি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, আসামির বিরুদ্ধে এজাহারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। আসামি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। আসামিকে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেনি।। সহযোগী আসামিরা জামিনে আছে। আসামি সম্পূর্ণভাবে ষড়যন্ত্রের শিকার মাত্র। সার্বিক বিবেচনায় ৫ হাজার টাকা বন্ডে, দুইজন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির জিম্মায় আগামী ধার্য তারিখ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করা হলো।
এ ধরনের আদেশে ক্ষুব্ধ হয়ে ৭ মার্চ বাদীপক্ষ জেলা জজ আদালতে একটি দরখাস্ত দেয়। যেখানে তারা ফৌজদারি কার্যবিধি ৫২৬ (বি) ধারা মোতাবেক বিচারিক আদালতটি পরিবর্তনের আবেদন করেন।
আদালত পরিবর্তনের জন্য করা আবেদন সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ ডিসেম্বর এ হত্যা মামলার এক আসামি রাশেদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করে সাতকানিয়া থানা পুলিশ। এজাহারভুক্ত এ আসামি মামলা দায়েরের পর থেকে পলাতক ছিলেন। পরে তাকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্রও দেওয়া হলে আদালত বাদীপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ৭ বছর পলাতক থাকার পর গ্রেপ্তার হয়ে মাত্র ২৩ দিনের মাথায় ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ ফারজানা আকতারের আদালত থেকে তিনি জামিন পান। জামিনের আবেদন করেন তার ফুফাতো বোন অ্যাডভোকেট রহিমা আক্তার।
এদিকে দ্রুত তার জামিন হয়ে গেলে দীর্ঘদিন পলাতক থাকা রাশেদের নিকটাত্মীয় ও হত্যা মামলার আসামি তৌহিদুর রহমান আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এদিন সঙ্গে সঙ্গে তিনি চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ ফারজানা আকতারের আদালত থেকে জামিন পেয়ে যান। এ নিয়ে আদালত অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এরপর আসামিরা এলাকায় বলাবলি করেন তাদের আইনজীবী রহিমা আক্তার এবং বিচারক ফারজানা আকতার বান্ধবী। সবশেষ একই আদালত থেকে গ্রেপ্তারের মাত্র একদিনের মাথায় জামিন পান হত্যা মামলার আসামি সেলিম।
নেপথ্যের কারণ হিসেবে জানা যায়, আইনজীবী রহিমা আক্তার ও বিচারক ফারজানা আকতার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একই ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি সাতকানিয়ার বাজালিয়া ইউনিয়নে মসজিদ ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসার ওয়াকফ করা (দান করা) জায়গা নিয়ে বিরোধের জের ধরে সংঘর্ষ বাধে দুই পক্ষের। প্রতিপক্ষের হামলায় আহত আবুল হাশেম এবং আবু মুছা সিকদারকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কয়েকদিন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় ১৩ জানুয়ারি আবুল হাশেম মারা যান।
এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই মসজিদ কমিটির সভাপতি আবু মুছা সিকদার বাদী হয়ে ১৭ জনের বিরুদ্ধে সাতকানিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করেন সাতকানিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ফজলুল হক। তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ১০ জনকে আসামি এবং সাতজনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে চট্টগ্রাম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। তবে মামলার বাদী আদালতে অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দেন। সেই আবেদন গ্রহণ করে আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেন।
সংস্থাটির চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটে কর্মরত পরিদর্শক আবু জাফর মো. ওমর ফারুক মামলাটির তদন্ত করেন। তিনি ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরে আদালত আরও তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন।
বর্তমানে আদালতে আসামি মোস্তাফিজুর রহমান, আমিনুর রহমান, হারুন অর রশিদ, মো. সোলায়মান, জাফর আহমেদ, আতিকুর রহমান, মুজিবুর রহমান, মো. জাকারিয়া, বজলুর রশিদ, মাহফুজুর রহমান, মাশুকুর রহমান, মো. সেলিম, তৌহিদুর রহমান, রাশেদ হোসেন ও মো. আনোয়ারসহ মোট ১৫ জনের বিরুদ্ধে বিচার চলমান আছে।