প্রকল্পের টাকায় মুরগির ঘর নির্মাণে অনিয়ম, অভিযোগ দেওয়ায় হুমকি

প্রকল্পের টাকায় মুরগির ঘর নির্মাণে অনিয়ম, অভিযোগ দেওয়ায় হুমকি

প্রথম নিউজ, গাইবান্ধা: গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে স্ক্যাভেনজিং পোলট্রির পরিবেশবান্ধব ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এনিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে  বিভিন্ন গণমাধ্যম। তবে গণমাধ্যমে এ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার কারণে উপকারভোগীদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

উপকারভোগীরা বলছেন, ব্যাংকে তাদের নামে টাকা বরাদ্দ এসেছে। ওই টাকা উত্তোলন করে তাদেরই এ ঘর নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু প্রাণিসম্পদ অফিসের কর্মকর্তা উপকারভোগীদের ছাড়াই এ টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো ঘর নির্মাণ করেছেন। এনিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলায় তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার কারণে তালিকা থেকে নাম বাদসহ ঘর তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন কর্মকর্তারা।

সর্বানন্দ ইউনিয়নের তালুক বাজিত গ্রামের মৌসুমী আক্তার বলেন, ‘মুরগির ঘর নির্মাণে বিভিন্ন অনিয়মের কথা সাংবাদিকদের বলার কারণে অফিসাররা হুমকি দিচ্ছেন। তারা বাড়িতে এসে ভিডিওতে বলতে বলছেন, তাদের কাছে সাংবাদিকরা এসব কথা শিখিয়ে দিয়ে ভিডিও করেছেন। এগুলো না বললে সদস্য থেকে নাম কেটে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন তারা।’

একই গ্রামের জুঁই আক্তার বলেন, ‘অফিসার এসে বলে যাচ্ছেন যারা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাদের নাম কেটে দেবেন। তিনি বলেন, ‘এমন ঘর করে দিয়েছে যে ঘরে রাতে মুরগি রাখাও নিরাপদ নয়। তারা যদি ঘর নিয়ে যায় তাতেও কোনো আপত্তি নেই।’

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পরিবেশবান্ধব ১৪৬টি মুরগির ঘর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে মোট ব্যয় ধরা হয় ২৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। প্রকল্পের শর্ত অনুযায়ী, সুবিধাভোগীদের নামে ব্যাংকে চেক বরাদ্দ করা হবে। সেই টাকা তুলে তারা ঘর নির্মাণ করবেন। আর এ কাজে সহযোগিতা করবেন মাঠ পর্যায়ের লাইভস্টক সার্ভিস প্রোভাইডাররা (এলএসপি)।

তবে অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফজলুল করিম সব শর্ত ভঙ্গ করে এলএসপিদের মাধ্যমে সদস্যদের কাছ থেকে চেকে সই করে নেন। পরে তিনি নিজেই সব সদস্যর টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে এলএসপিদের মাধ্যমে মুরগি রাখার ঘর নির্মাণ করে দেন। যা সদস্যদের কোনো কাজেই আসছে না বলে দাবি উপকারভোগীদের। এনিয়ে সোমবার (২৩ অক্টোবর) ‘ওই ঘরে মুরগি রাখলে গাড়োয়া ঠ্যাং টানি নিয়ে যায়’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাগো নিউজ। প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর থেকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রকল্পের সদস্যদের বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) প্রডিউসার গ্রুপের (পিজি) সদস্যদের জন্য ইনভেস্টমেন্ট সাপোর্টের আওতায় মুরগির পরিবেশবান্ধব শেড (ঘর) নির্মাণের জন্য এ বরাদ্দ দেওয়া হয়।

প্রকল্পের অর্থ দিয়ে ঘর নির্মাণের জন্য উপকারভোগীদের সঙ্গে ৩০০ টাকার নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তিনামা সম্পাদন ও ফাঁকা চেকে সই নেন প্রকল্প কর্মকর্তা। ঘরপ্রতি বরাদ্দ ছিল ২০ হাজার টাকা। উপকারভোগীরা জানান, ঘর নির্মাণের কাজটি তাদেরই করার কথা ছিল। তবে প্রকল্পের ডিজাইন অনুযায়ী অফিসের কর্তারা শেড তৈরি করে দেবেন—এমন প্রতিশ্রুতিতে তারা কাজটি তাদের করতে দেননি। নিম্নমানের কাঠ, ইট, পরিমাণে কম বালু ও সিমেন্ট দিয়ে নির্মাণ কাজ শেষ করেছেন। এখন সেই ঘরে মুরগি রাখতে ভয় পাচ্ছেন তারা।

তারা আরও জানান, পরিবেশবান্ধব শেড (ঘর) হওয়ার কথা ছিল চৌচালা। কিন্তু করা হয়েছে দোচালা। চালে দেওয়ার কথা ছিলো মেরুন রঙের ০.৪৫৭ মিলিমিটার গেজ পুরু ইন্ডাস্ট্রিয়াল টিন। দেওয়া হয়েছে ০.২৬০ মিলিমিটার পুরত্বের টিন। টিনের তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য চালে ব্যবহার করা হয়নি ইনসুলেটর। বেড়ায় প্লাস্টিকের জালি দেওয়া হয়েছে। অথচ সেখানে দেওয়ার কথা ছিল প্লাস্টিকে মোড়ানো ১৪ নম্বর গেজ জিআই তারের জালি।

১০ মিলিমিটার সাইজের রডের তৈরি দরজা দেওয়ার থাকলেও সেখানে দেওয়া হয়েছে কাঠের দরজা। এক ফুট উচ্চতার ১০ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনির ৯টি পিলার হওয়ার কথা থাকলেও পিলার করা হয়েছে সাতটি। খুঁটি চারটির নিচে দেওয়া হয়নি কোনো ইট। অথচ প্রতিটি খুঁটির নিচে একটি করে ইট ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া আছে। সদস্যদের হুমকি-ধমকি দেওয়ার বিষয়ে সর্বানন্দ ইউনিয়নের লাইভস্টক সার্ভিস প্রোভাইডার (এলএসপি) রিপন মিয়া বলেন, ‘উপজেলা প্রাণিসম্পদ স্যার যে কথা বলবেন আমি কি তার বাইরে যেতে পারি?’ এসময় আর কোন কোন সদস্য অভিযোগ করছেন তার নাম জানতে চান তিনি।

রিপন মিয়া আরও বলেন, ‘এসব ঘর দেওয়াই কি ভুল হয়েছে? আসলে যারা সাংবাদিকদের অনিয়মের কথা বলেছেন তাদের ঘর করে দেওয়াই দোষের কাজ হয়েছে। যাদের পছন্দ হয়নি তারা ঘর না নিলেই পারেন। এ বিষয়ে জানতে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফজলুল করিমের অফিসে গেলে জরুরি মিটিংয়ের কথা বলে তিনি চলে যান। পরে একাধিকবার তার ফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাহফুজার রহমান বলেন, শিডিউলের বাইরে কাজ করার সুযোগ নেই। সদস্যরা অনিয়মের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর যদি তাদের হুমকি দিয়ে থাকে তাহলে চরম অপরাধ করেছে। তিনি আরও বলেন, দ্রুত মুরগির ঘরগুলো পরিদর্শন করবো এবং সদস্যদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবো। কোনো ধরনের অনিয়ম প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।