নিত্যপণ্যের বাজারে হ য ব র ল!
অর্থনীতিবিদগণের শঙ্কা- আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার আরও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। কারণ ডলারের মূল্য একলাফে ৭ টাকা বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে তা বোঝাই যাচ্ছে।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: এ বছরের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ নতুন সরকার গঠনের পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকারের ঘোষণা দিয়েছিল। নতুন মন্ত্রিসভার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের আশার বাণী শুনিয়েছিল। এরপর বিভিন্ন পণ্যে শুল্কছাড় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ছুটেই চলেছে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া। বাজারে আলু, পিয়াজ, রসুন, ডিম, মুরগি, গরুর মাংস, সবজি, মসলাসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম লাগামহীন। আগে থেকেই উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, চিনি, আটাসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য। এসব পণ্যের সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। অথচ বাজারে স্বস্তি ফিরছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধিতে হাঁসফাঁস অবস্থা সাধারণ মানুষের।
অর্থনীতিবিদগণের শঙ্কা- আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার আরও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। কারণ ডলারের মূল্য একলাফে ৭ টাকা বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে তা বোঝাই যাচ্ছে। অর্থাৎ এই অর্থবছরের জুনের মধ্যে সরকারের সংশোধিত মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন।
বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মাথায় গত এপ্রিলে দাবি করেন- মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমে নেমে আসছে। কিন্তু বাস্তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশে উঠেছে বলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষণায় উঠে আসছে। গত সপ্তাহে বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, সম্প্রতি সব জেলা থেকে তথ্য নিয়ে তারা মূল্যস্ফীতি হিসাব করেছেন। তাতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ পেয়েছেন। এ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নআয়ের মানুষ অসুবিধায় রয়েছেন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত এপ্রিলে গড় মূল্যস্ফীতি ৯.৭৪ শতাংশ। যার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১০.২২ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, নিত্যপণ্যের বাজারে হচ্ছেটা কী? একের পর এক পণ্যের দাম বাড়ছে। শুধু বৈঠক করে দাম নির্ধারণ করলেই দায় শেষ নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণে সময়মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কী করলে সেটি কমবে, তার উদ্যোগ নেই। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ৫৭টি পণ্যের দৈনিক বাজার তালিকার তথ্যে দেখা যায়, গত এক মাসে ২৫টির দাম বেড়েছে। কমেছে ১৩টির। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কমার হার খুব কম এবং যেসব পণ্যের চাহিদা কমেছে, সেগুলোর দামই কমতি।
সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালের ৯ই মে তারিখে বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, আলুর কেজি সর্বনিম্ন ২২ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ টাকার মধ্যে ছিল। এবার সেই আলুর দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। গত বছরের তুলনায় মূল্যবৃদ্ধি ৫৭ শতাংশ।
আলু হিমাগার মালিক সমিতির সভাপতি এবং এফবিসিসিআই সাবেক সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, মার্চে নতুন মৌসুমের আলু ওঠার পর হু হু করে দাম বেড়ে যায়। সেই দামে আলু হিমাগারে রেখে এখন কম দামে বিক্রি করা সম্ভব নয়। বাজারে জনপ্রিয় সবজি বেগুনের দামের চিত্রটি আরও উদ্বেগজনক। ২০২১ সালে যে বেগুন প্রতিকেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা ছিল, তা বাড়তে বাড়তে এখন কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা হয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, বিগত এক মাসে বেগুনের দাম বেড়েছে ১৫৭ শতাংশ। সার্বিকভাবে সবজির দাম চড়া। ঢাকার বাজার ঘুরে কয়েকদিনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সবজির কেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা।
২০২১ সালের ৯ই মে ঢাকার বাজারে পাঙাশ মাছের কেজি ছিল ১২০ থেকে ১৪০ টাকা। তা এখন ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা। বেড়েছে রুই, কাতলা ও ইলিশের দামও (অন্য মাছের দামের হিসাব রাখে না কৃষি বিপণন অধিদপ্তর)। ঈদের আগে এক কেজি ছোট ও মাঝারি আকারের পাঙাশের দাম ছিল ১৮০-২২০ টাকা, সেই একই পাঙাশ এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৫০ টাকায়। দাম বেড়ে তেলাপিয়া মাছের কেজি ২৫০ টাকা ছাড়িয়েছে। মাঝারি ও বড় মানের তেলাপিয়া প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০-২৮০ টাকায়। ঈদের আগে যা ছিল ২২০-২৫০ টাকা। চাষের কই বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৫০ টাকার উপরে। আর ৬০০-৭০০ গ্রাম ওজনের চাষের রুই মাছের দাম হাঁকানো হচ্ছে ২৮০-৩০০ টাকা কেজি। বড়গুলো ৩৬০-৪০০ টাকা।
বাজারে এখন ফার্মের সোনালি জাতের মুরগির কেজি ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, এক মাসে দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। বছর চারেক আগেও এই মুরগি সাধারণত ২২০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি বিক্রি হতো। অসচ্ছল মানুষের পক্ষে এখন ব্রয়লার মুরগি ও ডিম কেনাও কঠিন। এক হালি ডিম উঠেছে ৫০ টাকায়, যা সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করতো। গরুর মাংসের কেজিপ্রতি দর ৭৫০-৮০০ টাকা। দুই সপ্তাহ আগেও ফার্মের লাল ডিম প্রতি ডজন বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে হয়েছিল ১৩০ টাকা। দুই দফায় দাম বেড়ে এখন ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরমে মুরগি মারা যাওয়াও ডিমের দাম এমন হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। বাজারে ফার্মের সাদা ডিম প্রতি ডজন ১৪০ টাকা, দেশি মুরগির ডিম ২৪০ টাকা ও হাঁসের ডিম ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২১০ টাকা ও পাকিস্তানি মুরগি ৩৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) হিসাবে এক বছরে ডিমের দাম বেড়েছে ২.১১ শতাংশ।
বাজারগুলোতে পটোল আর ঢেঁড়স বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৬০-৮০ টাকার মধ্যে। গাজর-শসা ও টমেটোও ৮০-১০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের দাম ৪০ টাকা বেড়ে ১৬০ টাকায় উঠেছে। সবজি বিক্রেতারা বলছেন, সপ্তাহ ব্যবধানে প্রতি কেজি সবজিতে দাম বেড়েছে ১০-১৫ টাকা পর্যন্ত। মূলত তীব্র গরমে গ্রাম পর্যায়ে সবজির দাম বাড়ায় রাজধানীর বাজারগুলোতেও এর প্রভাব পড়েছে।
রাজধানী রামপুরার বাসিন্দা মাইনুল ইসলাম বলেন, যেভাবে মুরগির দাম বাড়ছে তাতে কেনাই মুশকিল। সাধারণ মানুষ মাংসের চাহিদা মেটানোর জন্য ব্রয়লার মুরগির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বর্তমান বাজারে সেই ব্রয়লার মুরগির দামও বেড়েই চলছে। অথচ এক-দেড় বছরে বেতন বাড়েনি এক টাকাও। সাধারণ ক্রেতার কথা ভেবে বাজার মনিটরিংয়ের কোনো উদ্যোগ দেখি না। এত দাম দিয়ে সাধারণ নিম্নআয়ের ক্রেতাদের ব্রয়লার মুরগি কিনে খাওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সরকারের কিছু পদক্ষেপ বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে। যেমন গত রমজানে ২৮ পণ্যের দাম বেঁধে দেয়া হলো। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। সানেমের পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে সমন্বিত ও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
ভরা মৌসুমেও চালের দাম কমছে না: বাজারে নতুন ইরি ধান আসায় এখন চালের দাম কমার কথা। অথচ বাজারের চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। ভরা মৌসুমে বাজারে প্রতি কেজি চালের দাম যে হারে কমার কথা সেই তুলনায় কমেছে যৎসামান্য। রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি আটাশ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়, পায়জামের কেজি ৫৮ টাকা ও মিনিকেট ৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারদের অভিযোগ, মিল থেকেই বেশি রেটে চাল আসছে। প্রতি কেজি চালের মিলার রেট ৪ থেকে ৫ টাকা বেশি। এদিকে চালের দাম নিয়ে কারসাজি বন্ধে মিলগেট মূল্য চালের বস্তায় লেখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এতে চালকল ব্যবসায়ীরাই বেশি লাভবান হচ্ছেন বলে জানান খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
টিসিবি’র হিসাবে এক বছরে মোটা চালের প্রতি কেজি দাম বেড়েছে ৮.৩৩ শতাংশ। মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ৮.৭৪ শতাংশ। আর সরু চালের প্রতি কেজি দাম বেড়েছে ৩.৭০ শতাংশ। কাজীপাড়া এলাকায় অবস্থিত খুচরা চাল বিক্রেতা আবুল বাসার বলেন, ভরা মৌসুমে চালের দাম কমার কথা ছিল। সব থেকে বেশি বেড়েছে মিনিকেটের দাম। গত বছরের তুলনায় কেজিতে এই চালের দাম ১৫ টাকা বেড়েছে। গত বছর ভরা মৌসুমে আটাশ ও পায়জাম জাতের চালের কেজি ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। এ ছাড়া মিনিকেট ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে সেই তুলনায় কয়েক টাকা কমেছে।
কাওরান বাজারের চালের আড়ত ঘুরে দেখা যায়, একটি গ্রুপের ২৫ কেজি প্যাকেটজাত নাজিরশাইল চালের মিলার রেট ১৭২৫ টাকা। আরেকটি গ্রুপের মিনিকেটের ২৫ কেজির বস্তার মিলার রেট ১৬২৫ টাকা, ৫০ কেজির বস্তার মিলার রেট ৩৩০০ টাকা। মিলার রেট অনুযায়ী, প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ৬৫ টাকা, আটাশ চালের কেজি ৫০ টাকা, পায়জাম ৫০ থেকে ৫২ টাকা ও নাজিরশাইল এর কেজি ৬৯ টাকা পড়েছে। এই বাজারের খুচরা বিক্রেতারা জানান, গত মৌসুমের তুলনায় ৫ টাকা বেশি দামে তাদের এসব চাল কিনতে হচ্ছে।
চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, প্রতিনিয়ত বস্তায় রেট দিচ্ছি। রাতারাতি সব ঠিক করা সম্ভব না। সরকার যেটা (মিলগেট মূল্য) পাস করেছে, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কি দামে চাল কিনছে বা বিক্রি করছে তা এমনিতেই ধরা যাবে।