দেশব্যাপী সাঁড়াশী অভিযানে ৬ হাজারের বেশি গ্রেপ্তার, ৫৫০ মামলা
মহানগর থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, জামায়াত, ছাত্রশিবিরসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন।
প্রথম নিউজ, অনলােইন ডেস্ক: কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা, নাশকতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দেশব্যাপী চলছে যৌথ অভিযান ব্লক রেইড। মহানগর থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, জামায়াত, ছাত্রশিবিরসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশের বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশের ৫১টি মহানগর ও জেলায় প্রায় ৫৫০টি মামলা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলার বাদী পুলিশ। এ ছাড়া ছাত্রলীগও অনেক মামলার বাদী। এসব মামলায় গত ৬ দিনে ৬ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, সহিংসতার ঘটনায় আরও মামলা হবে। যারা নাশকতার সঙ্গে জড়িত তাদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেছেন, ডিএমপি’র আওতাধীন থানা এলাকায় সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২ হাজার ৩৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার সংখ্যাও বাড়ছে, গ্রেপ্তারও বাড়ছে। গতকাল র্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, সাম্প্রতিক সহিংসতা, নাশকতা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ঢাকায় ৬৩ জনকে র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন গ্রেপ্তার করেছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন বিভিন্ন জেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২০৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। সবমিলিয়ে র্যাব ২৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সারা দেশে গত ৬ দিনে যে পরিমাণ মামলা হয়েছে তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায়। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ডিএমপিতে মামলার সংখ্যা ছিল ২০১টি। আর গ্রেপ্তার ছিল ২ হাজার ২০৯ জন। তবে শুক্রবার আরও ৮টি মামলা হয়েছে। আর গ্রেপ্তার হয়েছে আরও ১৪৮ জন। ডিএমপি’র মামলা বাদে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশের অন্যান্য স্থানে মামলা ছিল ২৯৯টি। আর গ্রেপ্তার ছিল ২ হাজার ২৯১ জন। তবে শুক্রবার মামলা-গ্রেপ্তার দুটিই বেড়েছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, ঢাকার বাইরে ৩৫টির মতো মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারও হয়েছেন কয়েকশ’।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এলাকার বাইরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি), সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি), রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি), চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি), রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি), ঢাকা পুলিশ, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, সিলেট, কুমিল্লা, বরিশাল, দিনাজপুর, ফরিদপুর জেলায় মামলা হয়েছে বেশি।
সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা জেলার পুলিশের বিভিন্ন থানায় প্রায় ২০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলায় ১৪ মামলায় ৪৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একইভাবে নরসিংদী জেলায় ১১ মামলায় প্রায় ২০০ জন, গাজীপুরে ২৮ মামলায় ৩৫০ জন, সিলেটে ১২ মামলায় ১৪০ জন, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় প্রায় ৩০টি মামলায় ৮০০ জন, রাজশাহীতে ১৭টি মামলায় ২৮০ জন, রংপুরে ১২টি মামলায় ১৫০ জন এবং বগুড়ায় ১৪টি মামলায় ১২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগে ১৬টি মামলায় ১৬০ জন, বরিশাল বিভাগে ৫ মামলায় ১২০ জন ও খুলনায় ৪টি মামলায় শতাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ডিএমপির সূত্রগুলো বলছে, থানা পুলিশের পাশপাশি ডিবি, র্যাব ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে রাতে অভিযান পরিচালনা করছে। পুলিশের ধারণা কোটা আন্দোলনকে ঘিরে যারা সহিংসতা, নাশকতা ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছে। তাই এলাকা ধরে ধরে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া নাশকতার ইন্ধনদাতা, অর্থদাতাদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তাদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন নেতা ও সাধারণ আন্দোলনকারীরা বলছেন, পুলিশ ও ছাত্রলীগ বাদী হয়ে বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করছে। এসব মামলায় অনেক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ ছাড়া অনেকে পুলিশি হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
এদিকে, রায়ের বাজার, শনির আখড়া এলাকায় দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, ডেমরা থানা ছাত্রদল আহ্বায়ক মাসুদ রানা, ইরফান, আবু বক্কর, রবিউল ইসলাম, সৌরভ মিয়া ও তারেক। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, ডেমরা থানা ছাত্রদল আহ্বায়ক মাসুদ রানার নেতৃত্বে পুলিশ হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয়। একেকজনের ছিল একেক দায়িত্ব।
ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট প্রমাণসাপেক্ষে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি, গ্রেপ্তার ডেমরা থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মাসুদ রানার নেতৃত্বে, ইরফান, আবু বক্কর, রবিউল ইসলাম, সৌরভ মিয়া ও তারেকসহ ২৫-৩০ জনের একটি দল গত ১৯শে জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য যাত্রাবাড়ী থানাধীন রায়েরবাগে অবস্থান করে। এ ছাড়াও মাসুদ রানার উপস্থিতি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় ইরফান ও বক্কর আরও কয়েকটি দল নিয়ে এসে তার সঙ্গে যোগ দেয়। মাসুদ রানার নেতৃত্বে তারা রায়েরবাগ-শনির আখড়া এলাকায় অগ্নিসংযোগ এবং মসজিদের মাইকে গুজব ছড়ানো, থানা আক্রমণ এবং পুলিশ হত্যায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টায় তারা এক মোটরসাইকেল আরোহীকে তাড়া করে। তাদের তাড়া খেয়ে মোটরসাইকেল আরোহী রাস্তার পাশে পড়ে গেলে মাসুদ রানা ও তার সহযোগীরা সেই ব্যক্তির ব্যাগ তল্লাশি করে পুলিশের পোশাক ও আইডি কার্ড দেখতে পায়। তখন তারা পুলিশ পুলিশ বলে চিৎকার করে। তাদের চিৎকারে আশপাশের অনেকে সেখানে জড়ো হয়। তাদের হাতে থাকা হকিস্টিক, বাঁশ, লাঠি ইত্যাদি দিয়ে ওই পুলিশ সদস্যকে মারতে থাকে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে। তার মৃতদেহ নিয়ে তারা উল্লাসে মেতে ওঠে। তার চালিত মোটরসাইকেলটিতেও তারা অগ্নিসংযোগ করে। আন্দোলনে যাওয়ার জন্য তাদেরকে কেন্দ্রীয় যুবদলের সদস্য তারেক অর্থ সহায়তা দিতো এবং তার নির্দেশে তারা অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের কাজ করেছে।
হারুন অর রশীদ বলেন, পরের দিন ২০শে জুলাই সকালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ওই এলাকায় মোটরসাইকেলে করে সাদা পোশাকে একজন ব্যক্তিকে আসতে দেখে দুষ্কৃতকারীরা ধাওয়া করে, তাকে ধরে ফেলে এবং পুলিশ সদস্য বুঝতে পেরে তাদের হাতে থাকা হকিস্টিক, বাঁশ, লাঠি ইত্যাদি দিয়ে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। তার মোটরসাইকেলটিও একইভাবে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। হারুন বলেন, যারা পুলিশকে হত্যা করেছে, সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, স্বপ্নের মেট্রোরেলসহ সরকারি স্থাপনায় নাশকতা চালিয়েছে। যারা এসবের নেতৃত্ব দিয়েছে, অর্থ আদানপ্রদান করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।