চার বছর পর ক্লুলেস হত্যার রহস্য উদঘাটন করলো পিবিআই

খুন করে চলে যান ব্রুনাই

চার বছর পর ক্লুলেস হত্যার রহস্য উদঘাটন করলো পিবিআই


প্রথম নিউজ, ঢাকা: পরকীয়া প্রেমিককে ঢাকায় এনে বিয়ের আশ্বাসে ২০১৯ সালের ১৬ জুন চাঁদপুর থেকে লঞ্চে রওনা দেন। লঞ্চের কেবিনেই ওই নারীকে খুন করে সকালে ঢাকায় নেমে যান দেলোয়ার মিজি (৪৪)।

১৭ জুন সকালে মিতালী-৭ লঞ্চের কেবিন থেকে নিলুফা বেগম (৫৭) নামে ওই নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তবে লঞ্চের কেবিন বুকিংয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সেখানে নিলুফারের প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের নামে কেবিন নেওয়া। যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছিল সেটিও বন্ধ পায় পুলিশ।

এরপর পুলিশ হাজিগঞ্জে ভুক্তভোগী নিলুফার এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ওই এলাকার মুদি দোকানির নাম জাহাঙ্গীর। তবে ঘটনার দিন জাহাঙ্গীরের অন্য কোথাও যাওয়ার প্রমাণ পায়নি পুলিশ।

ক্লুলেস এই মামলার তদন্তে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদস্যরা সন্দেহ করেন নিলুফার আরেক প্রতিবেশী দেলোয়ারকে। কিন্তু ততদিন দেলোয়ার ব্রুনাই পাড়ি দিয়েছেন। রহস্যের কোনো কূলকিনারা করতে না পেরে অপেক্ষা করতে থাকেন তদন্ত কর্মকর্তারা, যাতে অপরাধী ভাবেন এ ঘটনায় পুলিশের আর কোনো আগ্রহ নেই।

দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার বছর অপেক্ষার অবসান ঘটে দেলোয়ার মিজির দেশে ফিরে আসার মাধ্যমে। গত ২২ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরার পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দেলোয়ারকে হেফাজতে নেয় পিবিআই। তবে কোনো ক্লু না থাকায় এবং দেলোয়ার স্বীকার না করায় অপেক্ষা আরও বাড়তে থাকে।

এক পর্যায়ে দেলোয়ারের মোবাইল ফোনে হোয়াটসঅ্যাপে এক প্রতিবেশীকে পাঠানো একটি ভয়েস মেসেজের সূত্র ধরে উদঘাটন হয় রহস্যের। একপর্যায়ে হত্যাকাণ্ডে নিজের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন দেলোয়ার।

যা ঘটেছিল ৪ বছর আগে
নিহত নিলুফা বেগম ২০১৯ সালের ১৬ জুন ঢাকায় আসার জন্য রাত ১০টার দিকে চাঁদপুর থেকে মিতালী-৭ লঞ্চের এস-৩০৯ নম্বর কেবিনে ওঠেন। পরদিন সকাল ৯টার দিকে লঞ্চের কেবিন বয় নিলুফার মরদেহ দেখতে পেয়ে থানা পুলিশকে খবর দেয়।

পিবিআইয়ের ক্রাইমসিন টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহতের ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে তার পরিচয় শনাক্ত করে। থানা পুলিশ নিহতের পরিবারকে বিষয়টি জানালে ভিকটিমের ভাই মনির হোসেন এসে মরদেহ শনাক্ত করেন।

লঞ্চের বুকিং লিস্টে নিলুফার প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের নাম এবং মোবাইল নম্বর ছিল ভিকটিমের। নিহত লিলুফা বেগমের সঙ্গে প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের সখ্য থাকায় তাকে সন্দেহ করে মামলার আসামি করা হয়।

থানা পুলিশ প্রায় এক মাসের তদন্তের পর মামলাটি পিবিআইয়ে হস্তান্তর করা হয়। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার বছরের অপেক্ষার পর মামলাটির রহস্য উদঘাটনসহ আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পিবিআই।

যেভাবে চলে তদন্ত
তথ্য-প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সালেহ ইমরান আসামি জাহাঙ্গীরের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। কিন্তু ঘটনার আগে-পরে জাহাঙ্গীরের কোনো মুভমেন্ট না পাওয়ায় অন্যপথে হাঁটতে থাকেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

তদন্তে নিহতের সঙ্গে একই গ্রামের আরেক ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ দেখে সেখানেও খোঁজ নেওয়া হয়। দেখা যায়, সে নম্বরটি প্রতিবেশী এক নারীর। ওই নারীর সঙ্গে নিহতের মাঝেমধ্যে কথা হতো বলে জানা যায়। তবে ওই নারী পুলিশকে জানান, তার ব্রুনাই প্রবাসী স্বামী দেশে ফিরলে মাঝেমধ্যে তার মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। তবে তিনি ২৬ জুন ব্রুনাই চলে গেছেন।

এক পর্যায়ে ব্রুনাই প্রবাসী দেলোয়ার মিজির সঙ্গে ভিকটিম নিলুফার পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়টি সন্দেহ হয়। পিবিআই দেলোয়ার মিজির পাসপোর্ট নম্বর সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশন পুলিশকে অবহিত করে।

বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) দুপুরে পিবিআই সদরদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।

তিনি বলেন, এরমধ্যে আমরা ওই এলাকায় কোনো তৎপরতা দেখাইনি। যাতে সবাই বুঝতে পারে পুলিশের এ নিয়ে আর কোনো আগ্রহ নেই। আমরা দেলোয়ারের দেশে ফেরার অপেক্ষা করতে থাকি।

দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে অপেক্ষার পর গত ২২ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরার পর ইমিগ্রেশন পুলিশের সহায়তায় বিমানবন্দর থেকে দেলোয়ারকে গ্রেফতার করা হয়। আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেরিয়ে আসে রহস্য।

যেভাবে রহস্য উদঘাটন
পিবিআই জানায়, প্রাথমিকভাবে দেলোয়ার কোনোভাবেই ভিকটিম নিলুফার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক বা হত্যাকাণ্ডের বিষয় স্বীকার করছিলেন না। তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনের পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন বলে জানান। ফলে সেটিও খোলা যাচ্ছিল না।

একপর্যায়ে পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা র‌্যান্ডম পসওয়ার্ড বসিয়ে ফোন আনলক করতে সক্ষম হন। খুঁজতে খুঁজতে তার হোয়াটসঅ্যাপে এক প্রতিবেশীকে পাঠানো একটি ভয়েস মেসেজে বেরিয়ে আসে ক্লু।

দেশে আসার কিছুদিন আগে পাঠানো ওই ভয়েস মেসেজে নিহত লিলুফা হত্যা মামলার খোঁজ-খবর নিতে বলেন এবং মামলা শেষ করতে যদি টাকা পয়সাও লাগে সে ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে বলেন। দেশে আসলে সমস্যা হবে না এমন আশ্বাসেই তিনি ব্রুনাই থেকে বাংলাদেশে আসেন।

এরপর এ বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে দেলোয়ার মিজি লিলুফা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেন।

যে কারণে হত্যা
জিজ্ঞাসাবাদে দেলোয়ার মিজি জানান, নিহত লিলুফা বেগমের স্বামী ২০১৫ সালে মারা যান। বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। ২০১২ সালের দিকে ভিকটিমের বাড়িতে কাঠমিস্ত্রীর কাজের সুবাদে তার সঙ্গে ভিকটিমের পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। ২০১৭ সালে তিনি ব্রুনাই চলে গেলে ভিডিও কলের মাধ্যমে তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকে।

দেলোয়ার মিজি ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল ২ মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। দেশে আসার পর তিনি লিলুফার সঙ্গে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক করেন। তখন লিলুফা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন। তিনি ভিকটিম লিলুফাকে বিয়ে করবেন বলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকলে নিলুফা তার বাড়িতে গিয়ে উঠার হুমকি দেন। দেলোয়ার মিজির বড় মেয়ের বিয়ের আয়োজন করা হলে লিলুফা সেখানে গিয়ে সম্পর্কের বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দেবেন বলে হুমকি দেন।

পিবিআই প্রধান আরও বলেন, দেলোয়ার মিজি নিলুফাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলেন। বিদেশে যাওয়ার আগেই তাকে বিয়ে করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন। ভিকটিম লিলুফা ১৩ বছরের বড় হওয়ায় দেলোয়ার মিজি এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। তাই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১৬ জুন নিলুফাকে বিয়ের কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য লঞ্চে রওনা দেন দেলোয়ার। প্রতিবেশী মুদি দোকানি জাহাঙ্গীরের নাম এবং ভিকটিমের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে লঞ্চের কেবিন বুকিং করেন।

লিলুফাকে হত্যা করে দায় জাহাঙ্গীরের ওপর সুকৌশলে চাপিয়ে দেওয়ার জন্যই তার নাম ব্যবহার করেন দেলোয়ার। পুলিশের সন্দেহ এড়াতে নিজের মোবাইল ফোনও বাড়িতে রেখে আসেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, দেলোয়ার এবং লিলুফা ১৬ জুন রাতে চাঁদপুর থেকে মিতালী-৭ লঞ্চের ৩য় তলার এস-৩০৯ নম্বর কেবিনে ওঠেন। লঞ্চ ছাড়ার পর রাত ১২টার দিকে তিনি লিলুফাকে ধর্ষণ করেন। পরে রাত দেড়টার দিকে বিয়ের বিষয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তিনি নিলুফার গলা চেপে ধরে ও গলায় ওড়না পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।

পিবিআই প্রধান বলেন, নিলুফার সঙ্গে তার সম্পর্কের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ভিকটিমের মোবাইল ফোনে থাকায় তিনি ভিকটিমের দুইটি মোবাইল ফোন নিয়ে বিদেশে চলে যান। দেশে ফেরার সময় সেগুলো সঙ্গে আনেননি দেলোয়ার। যেহেতু সেই মোবাইল ফোনগুলো উদ্ধার করা যায়নি, ফলে আলামতও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। দেলোয়ার মিজিকে আদালতে সোপর্দ করা হলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি।