Ad0111

লাভের হাজার কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে চায় মেটলাইফ

বাংলাদেশ থেকে ১০ বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেছে মেটলাইফ: ব্যবসা করতে আনেনি কোনো পুঁজি

লাভের হাজার কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে চায় মেটলাইফ

প্রথম নিউজ, ঢাকা: বাংলাদেশে ১৯৫২ সাল থেকে ব্যবসা করছে জীবন বিমা কোম্পানি মেটলাইফ। কোম্পানিটি বাংলাদেশে শুধুই তাদের পণ্য বিপণন করছে। বিমা খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কোনো ভূমিকা রাখেনি। এমনকি কোম্পানিটি বিমা ব্যবসা শুরু করতে বাংলাদেশে কোনো অর্থই নিয়ে আসেনি। অথচ বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে।

মেটলাইফ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ২০১৩ সালে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়। এরপর দীর্ঘদিন কেটে গেলেও মেটলাইফকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে বাধ্য করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

 মেটলাইফকে বিশেষ ছাড় দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের উপকার হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। আমি মনে করি অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া উচিত নয়। যে আইন আছে, সেই আইন অনুসারে চলা উচিত। সবার ক্ষেত্রেই আইনের প্রয়োগ একই হতে হবে। বৈষম্য হওয়া উচিত নয়। আইনে যা আছে, সেই অনুযায়ী মেটলাইফকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে 

বাংলাদেশে ব্যবসায় নামলেও স্থানীয় কোনো মালিকানা রাখেনি মেটলাইফ। সেজন্য প্রতি বছর তারা যে মোটা অংকের মুনাফা করছে, মালিকদের অংশ হিসেবে তার পুরোটাই চলে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে।

আগে কয়েকশ’ কোটি টাকা নেওয়ার পর এখন প্রতিষ্ঠানটি মালিকদের মুনাফার অংশ হিসেবে হাজার কোটি টাকার বেশি যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেছে আইডিআরএর কাছে। এখনো (৮ ফেব্রুয়ারি) অনুমোদন দেওয়া না হলেও মালিকদের মুনাফার অংশ প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে পারবে বলে জানিয়েছেন আইডিআরএর দায়িত্বশীলরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আইডিআরএর কাছে সম্প্রতি মেটলাইফ ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯—এই চার বছরে মালিকদের লভ্যাংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে এক হাজার এক কোটি ৪৬ লাখ ১১ হাজার ৭৩২ টাকা নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেছে।

এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২৮০ কোটি ৪৭ লাখ ৭০ হাজার ৬৬ টাকা, ২০১৮ সালের ২৯৮ কোটি ৩৬ লাখ ৯৮ হাজার ৫৩০, ২০১৭ সালের ১৯০ কোটি ৫৪ লাখ দুই হাজার ৬০১ এবং ২০১৬ সালের ২৩২ কোটি সাত লাখ ৪০ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা রয়েছে।

মেটলাইফ এই টাকা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে আবেদন করলেও আইডিআরএ থেকে এখনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বিষয়টি আরও পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএর মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক এস এম শাকিল আখতার বলেন, মেটলাইফ আবেদন করেছে। আমরা এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেইনি। তবে তারা মুনাফার একটা অংশ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে পারবে।

বিদেশি এই বিমা কোম্পানিটি আলিকো নামে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে ১৯৫২ সালে। ২০১০ সালে সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলারে কোম্পানিটি কিনে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক জীবন বিমা কোম্পানি মেট্রোপলিটন লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি বা মেটলাইফ। তখন থেকে এর নতুন নামকরণ করা হয় মেটলাইফ আলিকো। পরে ২০১৫ সালে বাংলাদেশে কোম্পানিটি নাম বদলে রাখে মেটলাইফ। এ নামেই বর্তমানে কোম্পানিটি বাংলাদেশে ব্যবসা করছে।

বিমা আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিমা ব্যবসার জন্য নিবন্ধিত হওয়ার তিন বছর ছয় মাসের মধ্যে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আইনের এ বাধ্যবাধকতা থেকেও মুক্ত মেটলাইফ। অন্য বিমা কোম্পানির মতো মেটলাইফকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ছাড়াই ব্যবসা করে মেটলাইফ বছরের পর বছর যুক্তরাষ্ট্রে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়টি আইডিআরএ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রথম অবহিত করা হয় ২০১৩ সালে। সেই প্রথম সেই শেষ। এরপর কোম্পানিটিকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে বাধ্য করতে আইডিআরএ ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

২০১৩ সালে আইডিআরএ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মেটলাইফ ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে কার্যত কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই বাংলাদেশ থেকে পাঁচ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার ডলার (প্রায় ৫০০ কোটি টাকা) মুনাফা নিয়ে গেছে।

কোম্পানিটি বাংলাদেশে শুধুই তাদের পণ্য বিপণন করছে। বিমা খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কোনো ভূমিকা রাখেনি। এমনকি কোম্পানিটি বিমা ব্যবসা শুরু করতে বাংলাদেশে কোনো পুঁজি নিয়ে আসেনি। অথচ কোটি কোটি ডলার মুনাফা অর্জন করে নিয়ে যাচ্ছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

একাধিক বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মেটলাইফকে যেভাবে ছাড় দেওয়া হচ্ছে, তাতে দেশীয় কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়ার কারণে দেশীয় বিমা কোম্পানিগুলোকে প্রতিদিন জরিমানা গুনতে হচ্ছে। অথচ মেটলাইফকে কোনো জরিমানা দিতে হচ্ছে না। এতে দেশীয় কোম্পানিগুলোর আর্থিক ভিত দুর্বল হচ্ছে। সেই সঙ্গে মেটলাইফের মাধ্যমে দেশ থেকে বড় অংকের অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মেটলাইফকে বিশেষ ছাড় দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের উপকার হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। আমি মনে করি অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া উচিত নয়। যে আইন আছে, সেই আইন অনুসারে চলা উচিত। সবার ক্ষেত্রেই আইনের প্রয়োগ একই হতে হবে। বৈষম্য হওয়া উচিত নয়। আইনে যা আছে, সেই অনুযায়ী মেটলাইফকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হলেও মেটলাইফ পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে মোটা অংকের মুনাফা করা এই প্রতিষ্ঠানটিকে কেন বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে আইডিআরএর মুখপাত্র এস এম শাকিল আখতার জাগো নিউজকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে গিয়ে আমাদের কিছু কিছু জায়গায় ছাড় দিতে হয়। ওরা যখন বাংলাদেশে এসেছে, তখন যে চুক্তিনামা করা হয়, সেখানে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ কারণেই মেটলাইফকে অন্যরকম ভাবে দেখা হয়, অন্য কোনো কারণ নেই।

তিনি বলেন, মাঝে আমরা তাদের (মেটলাইফ) পুঁজিবাজারে আসতে বলেছিলাম। তারা বলেছে, আমাদের তো এই শর্ত ছিল না। আমরা আগে একটা চুক্তি করেছি, সেখানে শিথিলতা দেখিয়েছি। এখন আমরা হার্ডলাইনে গেলে, তারা যদি চলে যায়, তাহলে পুরো মার্কেটে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। বেশকিছু মানুষের বিমা পলিসি রয়েছে তাদের কাছে। আমাদের দেশের যে কোম্পানি আছে, তাদের থেকে তারা কিন্তু খারাপ করছে না।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে মেটলাইফের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান সাইফুর রহমান বলেন, দেশে আর্থিক বিনিয়োগ ছাড়াও বিমা শিল্পের গুণগত মান, মেধার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকারি ট্রেজারি বন্ডে মেটলাইফ অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী এবং এই বিনিয়োগ দেশের আর্থিক উন্নয়নে সরাসরি অবদান রেখে চলেছে। এছাড়া গ্রাহকরা যেন তাদের বিমা পলিসি থেকে যথাযথ আর্থিক সুরক্ষা পান তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত বিনিয়োগের নতুন নতুন ক্ষেত্র পর্যালোচনা করি।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বিমা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা দেশের মানুষের জন্য বিশ্বমানের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছি। আমরা বিশ্বাস করি দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবসা চালিয়ে আসা একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের বর্তমান অবস্থানের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের মানুষের জন্য দেশের অর্থনীতিতে যথাযথ অবদান রাখতে পারছি। এরই সূত্র ধরে আমরা দেশে আনতে পারছি বিদেশি বিনিয়োগ এবং বিমা সেবা।

বাংলাদেশে সরকারি ট্রেজারি বন্ড ছাড়া মেটলাইফের আর কোন খাতে বিনিয়োগ আছে কি না জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেননি সাইফুর রহমান।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

This site uses cookies. By continuing to browse the site you are agreeing to our use of cookies & privacy Policy from www.prothom.news