সরকার নিষিদ্ধ করলে আপত্তি নেই বিএনপি-জামায়াতের

সরকার নিষিদ্ধ করলে আপত্তি নেই বিএনপি-জামায়াতের

প্রথম নিউজ, অনলাইন:  আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াত এক ধরনের কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে এবং গতকাল শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার যে দাবি জানানো হচ্ছে সে বিষয়ে দল দুটি আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি। তবে সরকারি উদ্যোগে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হলে আপত্তি জানাবে না দল দুটি। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের বেশির ভাগ শরিকদের অবস্থানও প্রায় অভিন্ন।

এ বিষয়ে বিএনপির বরাবরই অবস্থান হচ্ছে, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করে আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে বিচারের আওতায় আনা হোক। গত ১০ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে লিখিত বক্তব্যেও বিএনপি এ দাবি জানিয়েছিল। 

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার যে দাবি তোলা হয়েছে তার মূল নেতৃত্বে রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ধর্মভিত্তিক দলগুলো। গতকাল শাহবাগ মোড়ে এনসিপির আন্দোলনে ধর্মভিত্তিক দলগুলো অংশ নিয়েছে।
জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা স্পষ্ট করে কিছু না বললেও দলটির নেতা শফিকুল ইসলাম মাসুদসহ শিবিরের নেতাকর্মীরাও অংশ নিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁরা কৌশলী অবস্থানে রয়েছেন।

অবশ্য, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘সরকার চাইলে নিষিদ্ধ করতে পারে। সেটি আইন-আদালতের মাধ্যমে করতে পারে।
আবার রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও করতে পারে। সিদ্ধান্ত আসলে সরকারের।’

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গতকাল শুক্রবার বিকেল ৩টার কিছু আগে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আগামীকাল রবিবার সরকার এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানতে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতে পারে।
তবে গতকাল রাত পর্যন্ত এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি বলে জানা গেছে।

সরকারের বিবৃতিতেও এর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও জনগণের পক্ষ থেকে স্বৈরশাসন ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, তা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। এ ব্যাপারে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এরই মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আদালতে আওয়ামী লীগের গণহত্যার বিচার চলছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটা আদালত এবং সরকারেরই নির্ধারণ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা নিয়ে কোনো আপত্তি জানাবে না বিএনপি। আদালতের মাধ্যমেও কোনো সিদ্ধান্ত এলে সে ব্যাপারেও কোনো পর্যবেক্ষণ দেবে না দলটি। তবে বিএনপি মনে করে, নিষিদ্ধের বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে হোক। তাহলে এটার আইনি ভিত্তি তৈরি হয়। সরকারের নির্বাহী আদেশে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার ফল অতীতেও সুখকর হয়নি।

গতকাল এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি হবে না, সেটা তো বিএনপির বক্তব্যের বিষয় নয়। এটা নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিএনপি হিসেবে তো আমরা এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক নই। আমাদের মহাসচিব (মির্জা ফখরুল ইসলাম) এরই মধ্যে বলেছেন, জনগণের সিদ্ধান্তের বিষয় এটা। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে—কারা নির্বাচন করবে কি করবে না। এটা হচ্ছে আমাদের বক্তব্য।’

বিএনপি আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ চায় না, রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন সময় এমন কথাও উঠে এসেছে। তবে বিএনপি বরাবরই বলেছে, কোনো দল নিষিদ্ধ করার তারা কেউ নয়। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক দেশের জনগণ। কে নির্বাচন করতে পারবে, কে করতে পারবে না, সে সিদ্ধান্ত জনগণই নেবে। বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা যখনই এ ধরনের (আ. লীগ নিষিদ্ধ) প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন, তখনই তাঁরা আরো বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে আখেরে লাভ হয় না। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের বিষয়ে তারা বলেছিল, গত স্বৈরাচার সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু কিছুদিন পর সেই সরকারই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার অব্যাহত দাবির মুখে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত না নিলেও গত বছরের ২৩ অক্টোবর দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছিল। সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নির্বাহী আদেশে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হলেও বিএনপি তখন কোনো আপত্তি জানায়নি। বরং সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে দলটি তখন বলেছিল, এটা সরকারের একটা সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।

বিএনপির মিত্র দল নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার চাইলে তো নিষিদ্ধ করা হতে পারে। আমরা তো নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে না, আপত্তিও করছি না। যারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে সেই নাগরিক পার্টি তো সরকারের দল। সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।’ তিনি জানান, সরকারের পক্ষ থেকে কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের বিষয়ে এখনো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি বলে জানান বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম সংগঠক সাইফুল হক। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মতো দলকে নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। এসব দলকে মোকাবেলা করতে হবে, রাজনৈতিক, আদর্শিক, সাংগঠনিকভাবে। আর সারা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এ ধরনের দলকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে হিতে বিপরীত হতে পারে। ওই দলের প্রতি সাধারণ জনগণের সিমপ্যাথি তৈরি হতে পারে। তারা সহানুভূতি পেতে পারে। আর নিষিদ্ধ করলে তাদের চিহ্নিত করা কঠিন হবে। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিষয়ে সাংবিধানিক ও আইনি জটিলতাও রয়েছে।’

তবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে জামায়াতের অবস্থান বেশ কৌশলী। তারা নিষিদ্ধের পক্ষের আন্দোলনে থাকছে। আবার নিষিদ্ধ করা হোক এমন কথাও সরাসরি বলছে না। এ বিষয়ে তাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বক্তব্য সব সময় কৌশলী।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে আলাদা করে নিষিদ্ধ করার কিছু নেই, জনগণই তাদের নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। বিচার হলো তাদের পাওনা।

গতকাল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে গিয়ে সব রাজনৈতিক দলকে ডেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার কথা বলেছেন জামায়াতের ঢাকা দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। আন্দোলনে অংশ নিলেও তিনি সব দল ডেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কৌশলী বক্তব্য দিয়েছেন। অবশ্য তিনি দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কেউ নন।

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পুত্র ও পিরোজপুর-১ আসনে জামায়াতে ইসলামী মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী মাসুদ সাঈদী গতকাল এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, খুন, গুম, হত্যা রাহাজানি, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, অরাজকতা সৃষ্টির দায়ে দেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। গোটা দেশকে যারা অস্থিতিশীলতায় নিমজ্জিত করে মহাবিপদে ফেলেছে, সেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এত দেরি কেন? কার স্বার্থে? অবিলম্বে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে দেশপ্রেমিক জনতার দাবি বাস্তবায়ন করা এখন সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব।

হেফাজতে ইসলাম গতকাল এক বিবৃতিতে বিনা বিচারে গণহত্যাকারী আওয়ামী স্বৈরাচারের দোসরদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ প্রদানের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে শাপলা ও জুলাইয়ের গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে দ্রুত নিষিদ্ধ ও বিচার করার দাবি জানিয়েছে।

সংগঠনটির আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব সাজেদুর রহমান বিবৃতিতে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত দলীয় নেতাকর্মীসহ ছাত্র-জনতাকে রাজপথ আঁকড়ে থাকার আহবান জানিয়েছেন।