স্বাস্থ্যের সেই মিঠু অবশেষে ফেঁসে যাচ্ছেন
বুধবার দুদক উপপরিচালক মশিউর রহমান এ সংক্রান্ত আবেদন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছেন। দুদক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: অতিগোপনে দেশে ফিরে নিজের বিপুল সম্পদের কিছুটা বিক্রির চেষ্টা করছেন স্বাস্থ্য খাতের বিতর্কিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠু। একই সঙ্গে তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট নবায়নের কাজেও দৌড়ঝাঁপ করছেন। এসব কাজে তাকে সহযোগিতা করছে প্রভাবশালী মহল। তাদের শেল্টারেই আছেন মিঠু। এমন খবরের পর তৎপর হয়ে উঠেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটি মিঠুর ৭৪ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করেছে। তার বিদেশযাত্রা ঠেকাতে চিঠি দিয়েছে ইমিগ্রেশন পুলিশকে। নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতেও আবেদন করা হয়েছে। বুধবার দুদক উপপরিচালক মশিউর রহমান এ সংক্রান্ত আবেদন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছেন। দুদক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য খাতে ঠিকাদারদের সিন্ডিকেট করে বিপুল অবৈধ অর্থ উপার্জন ও বিদেশে পাচারসংক্রান্ত অভিযোগ অনুসন্ধান চলমান। এ কারণে মিঠুর বিদেশ গমন রহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তার উপার্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। অনুসন্ধান শেষ হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
জানা যায়, মিঠুর বিদেশ গমন ঠেকাতে বুধবার পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মশিউর রহমান। একই দিন মিঠুর ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৩৮ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করতে আদালতে আবেদন করা হয়। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ১০ ও ১৪ ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭-এর ১৮ ধারায় মহানগর স্পেশাল জজ আদালতে আবেদনটি করা হয়েছে। আবেদনে জব্দ করা সম্পদের মধ্যে ৫৭ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার ২৩৮ টাকা অস্থাবর এবং ১৬ কোটি ৪১ লাখ ৯১ হাজার ৫০০ টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে দুদক জানতে পেরেছে, শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে দীর্ঘদিন স্বাস্থ্য খাতের ঠিকাদারির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ মিঠুর হাতে। এ সিন্ডিকেট বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মালামাল সরবরাহ ও উন্নয়ন কাজের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। যার মধ্যে দেশের ১২টি হাসপাতালের কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য-উপাত্ত পেয়েছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। দুর্নীতির মাধ্যমে মালামাল সরবরাহ দেওয়া হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ, ঢাকা ডেন্টাল হাসপাতাল ও রাজধানীর সিএমএসডি।
এছাড়াও ঢাকার বাইরে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল এবং আইএইচটি সিলেট। এসব হাসপাতালে নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে মালামাল সরবরাহ দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মিঠু। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ, দরপত্রের শর্তানুযায়ী মালামাল সরবরাহ না করা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মালামাল সরবরাহ না করেই বিল তুলে নেওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে দুদকের অনুসন্ধানে। এছাড়াও স্বাস্থ্য খাতে জাকির সিন্ডিকেট নামেও একটি ঠিকাদারি চক্রের দৌরাত্ম্য রয়েছে।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, অনুসন্ধানকালে মিঠুর বিরুদ্ধে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে। সম্প্রতি আমেরিকায় মিঠুর ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করার খবর বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপরই আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান তিনি। সেখান থেকে সম্প্রতি অতিগোপনে দেশে এসে বেশ কয়েকটি সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করেন তিনি। একই সঙ্গে নিজের বাংলাদেশি পাসপোর্টের মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত থাকার পরও নতুন করে ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন। আগামী সপ্তাহে ছবি তোলা, ফিঙ্গার দেওয়াসহ আনুষঙ্গিক কাজে তার পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে। মিঠুর আমেরিকান ও অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট আছে বলেও দুদকের কাছে তথ্য রয়েছে। দেশে কাজ শেষে বিদেশি যে কোনো একটি পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি ফের উড়াল দেবেন বলেও ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তার অন্তত পৃথক তিনটি জন্ম তারিখের তথ্য দুদকের হাতে এসেছে। এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পরই দুদক এখন পর্যন্ত অনুসন্ধানে মিঠুর যেসব অবৈধ সম্পদের তথ্য নিশ্চিত হতে পেরেছে, সেগুলো জব্দ ও অবরুদ্ধ করেছে। এসব সম্পদের মধ্যে আছে রাজধানীর বনানী ডিওএইচএস এলাকার রোড-৪/এ-তে ৫ কাঠা জমিতে পাঁচতলা বাড়ি, বানানীর ৬নং রোডের ব্লক সি’তে ১ হাজার ৮২৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ১০নং রোডে ৫ দশমিক ২৫ কাঠা জমিতে চারতলা বাড়ি, ৫ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডে ৬তলা বাড়ি, গুলশানের সুবাস্তু নজর ভিলায় ৩ হাজার ৭২৫ ও ৫৮৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ও ২টি কার পার্কিং, দক্ষিণ কল্যাণপুরের ১ নম্বর রোডে ১ হাজার ৫৮৩ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, উত্তরার ১৫সি রোডের ৩ কাঠার দুটি প্লট, টঙ্গী শিল্প এলাকায় ২ বিঘা জমি ও ভবন এবং রংপুরের বুড়িহাট রোডে কয়েক কোটি টাকায় নিজ বাড়ি।
জানা যায়, এসব সম্পদের বাইরেও একোয়া কালচার ফার্মস লিমিটেড, জিএমজি এয়ারলাইন্স, নর্থ চিকস প্রাইভেট লিমিটেড, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল, কছির উদ্দিন মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বায়ো মেডিকেল মার্চেন্টাইজ প্রাইভেট লিমিটেড ও আই পাইওনিয়র হ্যাচারি প্রাইভেট লিমিটেডে মিঠুর শতকোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। শেয়ারবাজারেও তার শতকোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। রয়েছে ব্যক্তিগত দুটি গাড়ি এবং সাউথইস্টসহ বিভিন্ন ব্যাংকে শতকোটি টাকার সম্পদ। এসব সম্পদের তথ্য-উপাত্তও পেয়েছে দুদক।
জানা যায়, ২০১৯ সালে মিঠুর বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য খাত থেকে অবৈধ পথে বিপুল অর্থ উপার্জন এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। ২০২০ সালের ৬ আগস্ট মাস্ক-পিপিই ক্রয় দুর্নীতির অনুসন্ধানে তলব করা হলেও অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তিনি হাজির হননি।
অনুসন্ধানে দুদক জানতে পেরেছে, স্বাস্থ্য খাত থেকে বিপুল অর্থ কামানোর পর ২০১৬ সালে ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’ হিসাবে পরিচিত দ্বীপরাষ্ট্রগুলোয় কোম্পানি খোলেন মিঠু। দুর্নীতির কারণে পানামা পেপারসে তার নাম উঠেছিল। এই দ্বীপরাষ্ট্র থেকেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্বের আবেদন করেন এবং বিনিয়োগ কোটায় নাগরিকত্ব পান। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে তার অবৈধ সম্পদের হিসাব নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে তার বিপুল সম্পদ সেখানে জব্দ করা হয়েছে বলে খবর শোনা যাচ্ছে। যে কারণে তিনি প্রভাবশালী একটি মহলের আশ্রয়ে অতিগোপনে দেশে ফেরেন।