শিক্ষার্থী তুলির মৃত্যুর ঘটনায় সুমনসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

কি ঘটেছিল সেদিন আইনজীবীর ফ্ল্যাটে, জন্মদিনেই লাশ হতে হলো তুলিকে ! 

শিক্ষার্থী তুলির মৃত্যুর ঘটনায় সুমনসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

প্রথম নিউজ, কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়ায় আইনজীবির বাড়িতে কুষ্টিয়া নার্সিং ইনস্টিটিউটের পথম বর্ষের শিক্ষার্থী তুলির রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় মাহমুদুল হাসান সুমন সহ ৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে আজ কুষ্টিয়া ডিসি কোর্ট চত্বরে মানববন্ধনের আয়োজন করেছে তুলির পরিবার স্বজনরা।

জানাযায়, গত ২২ আগষ্ট ছিলো জান্নাতুল ফেরদৌস তুলির জন্মদিন । অথচ ওই দিনই লশ হয়ে ফিরতে হলো তাকে। তুলি কুষ্টিয়া সদর উপজেলা মোল্লাতেঘরিয়া মোল্লাপাড়ার ওয়াহিদুল ইসলামের মেয়ে। ওই দিন ২২ আগস্ট কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের সামনের গলির মফিজউদ্দিন লেনের একটি বাড়ীর ফ্লাট থেকে টেনে হিচড়ে নামানো হয় জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র নিথরদেহ। তাকে দ্রুত কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগে পৌঁছানোর পর কর্তব্যরত ডাক্তার জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’কে দেখা মাত্রই মৃত বলে ঘোষনা করেন। অনেক আগেই তার মৃত্যু হয়েছে নিশ্চিত করেন ওই চিকিৎসক। 

খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যায় গণমাধ্যম কর্মিরা, সে সময় জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র পরিবারের পুরুষ কোন সদস্য ঐ সময় পর্যন্ত না পৌঁছালেও হাসপাতালের জরুরী বিভাগের পাশেই তালা বন্দী মৃতদেহের কাছে বুক চাপড়িয়ে আহাজারি করছিল তুলি’র মা ও বোন । হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্স ও উপস্থিত রোগীর স্বজনরা তাদের সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও মা বোনের বুক ফাটা আর্তনাদে তাদের চেষ্টা বৃথা হয়ে যায়। এ চিত্র দেখে চোখের কনে অশ্রু চলে আসে উপস্থিত অনেকের। এরই মাঝে পরিবারের আরো বেশ কয়েকজন সদস্য হাসপাতালে এসে উপস্থিত হন । 

পরে পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায় হাসপাতালের মর্গে। ওই সময় তুলির বোন লাশ দেখতে চাইলেও তাকে দেখতে দেয়া হয়নি। মর্গে লশ নিয়ে যাওয়ার সময় তুলির মা বোন ও স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতালে এলাকার বাতাস ভারি হয়ে আসে। পরের দিন লশের ময়নাতদন্ত শেষে  দুপুরে লাশ কাটা ঘর থেকে তুলি’র লাশ বের হয়। এর পর সমস্ত নিয়ম কানুন শেষ তুলি’কে হস্তান্তর করা হয় পরিবারের নিকট । তুলি’র এই মরণ যাত্রায় সময় লেগেছিলো ৩১ ঘন্টা ।

তুলির পরিবারের ভাষ্যমতে বাড়ী থেকে বিয়ের কথা বললেও বিয়ে করতে রাজি ছিলো না তুলি । পরিবারের লোকজন হয়তো ধরণা করতে পারেনি বা জানতে পারেনি তুলি’র প্রাইভেট টিউটর ”কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার চক দৌলতপুর গ্রামের মৃত তক্কেল আলী’র পুত্র পেশায় আইনজীবী মাহমুদুল হাসান সুমনের সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে ছিলো তার । আর সব প্রেমের সম্পর্কের মত তাদের মধ্যেও হয়তো কথা হয়েছিলো সারাজীবণ এক সাথে, এক ছাদের নীচে সুখে-দূঃখে কাটিয়ে দেওয়ার । আর যেই কথা ও স্বপ্ন গুলো হয়তো অন্ধের মতো বিশ্বাস করে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলো তুলি । কিন্তু মিথ্যা হলো সেই স্বপ্ন,অগণিত প্রশ্ন রেখে চলে গেলো পরপারে। জিলা স্কুলের সামনের গলির মফিজউদ্দিন লেনের মাহমুদুল হাসান সুমনের যে ভাড়া ফ্লাট থেকে জীবিত অথবা মৃত জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র দেহ কয়েকজন মিলে টেনে হিচড়ে নামিয়ে নিয়ে আসে, তারাই বা কারা এ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেননা পুলিশ জানায়, লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দিচ্ছে ভিন্ন চিত্র। যে বাসা থেকে তুলির নিথর দেহ বেড় করা হয়। সে বাসা মাহমুদুল হাসান সুমন ভাড়া নিয়ে ছিলো মাত্র দিন দশেক আগে । ফ্লাটের মালিককে বলেছিলেন বিয়ে করে বউ নিয়ে থাকবেন তিনি । কথা মত নব্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে ১৮ আগস্ট ফ্লাটে উঠেন মাহমুদুল । কিন্ত মাহমুদুলের স্ত্রী হিসাবে তুলি ছিলো না । মাহমুদুলের স্ত্রী ছিলো কুষ্টিয়া হরিপুরের শালদহ গ্রামের এশা ইমরোজ।  এ নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্নের দেখা দিয়েছে।

অনেকের দাবি মাহমুদুল হাসান সুমনের বাসা বদল থেকে বিয়ে, সব কিছুই ছিলো পূর্ব পরিকল্পিত । তাই বাসা বদল বা বিয়ের খবর হয়তো জানতো না জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি । তাই হয়তো তুলি হন্নি হয়ে বেশ কয়েকদিন যাবত মাহমুদুল হাসান সুমনের বাসাও খুঁজেছেন । তারই ধারাবাহিকতায় বাসার ঠিকানাও পেয়েছিলেন । নাকি তাকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে বাসায় ডেকে নিয়েছিল সুমন সেটাও নিশ্চিত হতে তাদের মোবাইলে কল রেকর্ড দেখলেই বোঝা যাবে। 

 (২২ আগস্ট) সে মাহমুদুলের বাসায় যাবে। দুপুরের কড়া রোদ যখন পশ্চিমে হেলেছে, এমন একটা সময়ে পৌছে যায় জান্নাত কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের সামনে মফিজউদ্দিন লেনের একটি বাড়ীর সামনে। ঐ বাড়ীরই তৃতীয় তলায় মাহমুদুল নববধুকে নিয়ে বসবাস করছে। পাঁচ তলা এই ফ্লাট বাড়ীটির মালিক গোলাম নবী ও মিতা দম্পত্তি। প্রতি বছরের মত হয়তো জন্মদিনের উপহার হাতে মাহমুদুলকে দেখার চরম ইচ্ছে ছিল তার। সেদিন দেখা হয়েছিলো তুলি’র সাথে মাহমুদুলের, কিন্তু ইচ্ছা পূরণ হয়েছিলো কিনা তা নিশ্চিত নয়।

সিসিটিভি ফুটেজ ও বিভিন্ন সূত্রে জানাযায়, বাড়ীর মূল ফটকে পেীঁছানোর পর নীল জামা পরিহিত ১২/১৩ বছরের একটা ছেলে জান্নাতকে ভবনের মেইন গেট খুলে ভেতরে যেতে সহায়তা করে। এরপর ঘটনা তৃতীয় তলায়। দরজা নক করে খুলে দেবার সাথে সাথে জান্নাত ভেতরে ঢুকে পড়ে। মাহমুদুল তখন নির্বাক, তার স্ত্রী আশ্চর্য হয়ে যায়। জান্নাত তার স্ত্রী এশা ইমরোজ সামনের বার বার মাহমুদুলের অঙ্গীকারের কথা বলতে থাকে। মাহমুদুল তিক্তবিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের করে দেয় তুলিকে। জান্নাত তখন ভবনের ছাদে চলে যায় আবারো যাবার অপেক্ষা করতে থাকে। এর মাঝে মাহমুদুল ও তার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়ার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরে জান্নাত নেমে এসে আবার দরজা নক করে এবার মাহমুদুলের স্ত্রী দরজা খুলে দেন এবং জান্নাতকে ভেতরে নিয়ে যায়। সেসময় জান্নাতকে বাজে ভাষায় অকথ্য ভাবে কথা বলা হয়। এই অপমান সে সহ্য করতে না পেরে একটা রুমে ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তখনো মাহমুদুল ও তার স্ত্রীর মাঝে তুমুল ঝগড়া চলছে। জান্নাত ঐ ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করার চাইতে জান্নাতের সাথে মাহমুদুলের সম্পর্কের বিষয়টা বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে। বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলে ঐ ঘর থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা ধাক্কা দিতে থাকে, তখনো কোনো সাড়া না পেয়ে শেষে ৯৯৯ কল করে মাহমুদুল। । সাথে সাথে মাহমুদুল কুষ্টিয়া কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের বিষয়টি জানান। এরপর মহিলা পুলিশ ছাড়াই ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে এবং একই সময় বারের নেতারাও আসেন। পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে ঢোকে এবং জান্নাতকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে সেখান থেকে উদ্ধার করে, স্থানীয়দের সহয়তায় চ্যাংগোলা করে তিনতলা থেকে লাশ নিচে নামায়, তখনো কোন পুলিশ লাশের সাথে ছিল না। একজন নারী ঘরের মধ্যে দরজা আটকিয়ে খুলছে না এমন তথ্যের ভিত্তিতে মহিলা পুলিশ ছাড়া সেখানে কিভাবে পুলিশ যেতে পারে! একজন নারীর সুরতহাল তৈরীর জন্য একজন মহিলা দারোগারও প্রয়োজন হতে পারে। লাশ নিচে নামানোর পর বেশ অনেক সময় পুলিশের সাথে মাহমুদুলের বাসায় কি কথা বার্তা হয়েছে তা জানা যায়নি। তারপরও প্রাথমিক ধারনায় পুলিশ এটাকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করেছে এবং সিড়ি দিয়ে লাশ নামানোর সময় কোন পুলিশ সদস্যকে দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন তাহলে লাশ নামালো কারা? এ ব্যাপারে সুষ্ঠু  তদন্তের দাবি জানান তুলির পরিবার।

হাসপাতালে তুলিকে নিয়ে যাওয়ার পর জান্নাতের মার আহাজারি সকলের নজরে পড়ে। মা শরিফা খাতুন উপস্থিত সকলের সামনে চিৎকার করে বলতে থাকেন ‘আমার মেয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সে কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, আমি এর বিচার চাই’। তিনি জানান, ‘সকাল আটটায় বাড়ী থেকে ১০০ টাকা নিয়ে বের হয়, আজ তার জন্মদিন তাই বান্ধবীদের সাথে ঘুরবে। সন্ধায় আমার বড় জামাই মিশুক আলীকে ফোন করে ঐ উকিল জানায়, আমার মেয়ে তার বাসায় আত্মহত্যা করেছে’। সে সময় জান্নাতের বড় বোন তাসনিমও মায়ের সাথে ছিলেন। তুলির মা, বোন ও স্বজনদের দেওয়া তথ্য মতে প্রচন্ড পরিমাপের ধার্মিক জান্নাত যার সমস্ত শরীর বোরখায় ঢাকা এমন কি হাতেও মোজা পরা। এই ধরনের নারী আত্মহত্যার মত পাপ করবে এটা মোটেই বিশ্বাস করতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। ঘটনার পর থেকে সাংবাদিকরা অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও মাহমুদুলের সাথে সংযুক্ত হতে পারে নাই। অনেকে ধারনা করছে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আত্মগোপন করেছেন। তাদের ফোন বন্ধ।

গতকাল বাদ মাগবির চাঁদাগড়া মাঠ কবরস্থানে জানাযা শেষে হাউজিং কবরস্থানে জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’কে দাফন করা হয়। অনেকেই বলছে বিবাহর প্রতিশ্রুতি দিয়ে দৈহিক মিলনের ফলে জান্নাত অন্তঃসত্ত্বাও হতে পারে। সেই লজ্জায় সে এই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। তবে কি ঘটেছিল যে কারণে তুলিকে জন্মদিনেই লাশ হতে হলো। সে বিষয়ে সুস্থ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তুলি পরিবার ও সচেতনমহল। এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা সে বিষয়ে এখন ময়না তদন্তের রিপোর্টের অপেক্ষা....