রূপপুর ও রুশ জাহাজ নিয়ে আলোচনা চায় না বাংলাদেশ
আজ কমিশন বৈঠক শুরু
প্রথম নিউজ, অনলাইন : মান ভাঙাতে জাতিসংঘে মস্কোর বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ। তবুও অভিমান ভাঙেনি রাশিয়ার। রাশিয়ার ৬৯টি জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ নিয়ে তাদের উদ্বেগ রয়ে গেছে। দুই দেশের মধ্যে আজ শুরু হতে যাওয়া আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিশন বৈঠকে প্রসঙ্গটি উঠাতে পারে রাশিয়া। অপরদিকে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা পরিশোধের বিষয়েও আলোচনা করতে চাইতে পারে দেশটি। কিন্তু এ দুটি ইস্যুর কোনোটিই আন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈঠকে আলোচনা চায় না বাংলাদেশ।
বৈঠকে রাশিয়া জাহাজের ইস্যু তুলতে পারে বলে ধারণা করছেন ঢাকার কোনো কোনো কর্মকর্তা। পাশাপাশি রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা পরিশোধের পদ্ধতি নিয়েও রাশিয়া জানতে চাইতে পারে। জানতে চাইলে ইআরডি সচিব শরিফা খান আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিশন বৈঠকের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান। তিনি রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘সোমবার কারিগরি পর্যায়ের বৈঠকের মাধ্যমে আলোচনার ফলাফল থেকে জানব। তার ওপর ভিত্তি করে আমাদের পর্যায়ে বৈঠকে আলোচনা করব।’ তবে ইআরডি ইউরোপ ডেস্কের অতিরিক্ত সচিব উত্তম কুমার কর্মকার বলেছেন, ‘৬৯ রুশ জাহাজের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি রাজনৈতিক বিষয়। এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখাশোনা করে থাকে। ফলে এই বৈঠকে আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। অপরদিকে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা পরিশোধের পদ্ধতি নিয়ে আলাদা বৈঠক হতে পারে। এই বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়েও আমরা আলোচনা করতে চাই না।’
ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা রুশ জাহাজ উরসামেজর ভারতে কিছু সামগ্রী নামানোর পর বাংলাদেশ অভিমুখে রওয়ানা করে। ভারত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মান্য করে না। জাহাজটিতে রীপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম ছিল। গত ২০ ডিসেম্বর রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম নিয়ে বাংলাদেশের কাছাকাছি এলে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে যে, উরসামেজরের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে জাহাজটিকে তীরে ভিড়তে দেয়নি বাংলাদেশ। উরসামেজর পরে ভারতে ভিড়তে চাইলে এবার আর ভারত নোঙর করতে দেয়নি। ভারত থেকে মালাক্কা প্রণালি দিয়ে উরসামেজর কোথায় গেছে সেটা আর জানা যায়নি।
দুই দেশের দুই মত : রুশ জাহাজের ওপর সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা নিয়ে দুই দেশের দুই মত। রাশিয়া বলছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ বলছে, সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা হচ্ছে।
উরসামেজর বিদায়ের পর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা ৬৯ জাহাজকে বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি চিঠি দেয় নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের কাছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি ঘোষণাও করে। এতেই ক্ষুব্ধ হয় রাশিয়া। রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে রাশিয়া বলেছে, কোনো দেশের চাপে বাংলাদেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের পাশে ছিল রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা করেছে। বাংলাদেশের সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞায় দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে।
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হুমকিতে বাংলাদেশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ ভিন্নমত প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলি সাবরিন বলেছেন, জাহাজ কিংবা অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কারণে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটির আগে বাংলাদেশকে চাপে ফেলতে রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলব করেছিল রাশিয়া। বাংলাদেশ সম্পর্কের অস্বস্তি কাটাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত ছিল। এ কারণে বাংলাদেশকে ধন্যবাদও জানিয়েছে রাশিয়া। কিন্তু রাশিয়ার অভিমান ভাঙেনি। ঢাকায় রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকসান্দার মান্তিৎস্কি ৬৯ জাহাজের ওপর বাংলাদেশের সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে দৌড়ঝাঁপ করছেন।
অভিজ্ঞ কূটনীতিকরা মনে করেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা রুশ জাহাজ বাংলাদেশে আসতে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ বহুমুখী সম্পর্ক রয়েছে। তবে এভাবে ঘটা করে চিঠি ও ঘোষণা নিয়ে রুশ জাহাজের ওপর সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন ছিল না। বরং মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা রুশ জাহাজগুলোর কোনোটি বাংলাদেশে আসতে অনুমতি চাইলে অনুমতি না দিলেই যথেষ্ট ছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়ায় বিষয়টি বেশি ফলাও হয়েছে। এতে রাশিয়া উদ্বেগ দেখিয়েছে।
রূপপুর নিয়ে পৃথক বৈঠক : রূপপুরে ১৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে রাশিয়া। তাদের অর্থ পরিশোধ করা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর পর থেকে এই জটিলতার সূত্রপাত। ইউক্রেন যুদ্ধ এখন আরও কঠিন অবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিছুদিন আগেও পরমাণু হামলার ভয় দেখা দিয়েছিল। এখন ইউক্রেনের ড্রোন মস্কোর কাছাকাছি গিয়েও পড়ছে। অপরদিকে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্ররা সুপারসনিক এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দেবে শোনার পর রাশিয়া আকাশ থেকে হামলা শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে চলছে এই হামলা। তারপর সুপারসনিক বিমানেও হামলার আশঙ্কা রয়েছে। ন্যাটো এফ-১৬ সুপারসনিক যুদ্ধবিমান দিলেও সেগুলো পরিচালনায় দক্ষতা অর্জনে সময় নেবে ইউক্রেন। তাই আগেভাগে রাশিয়া বিমান হামলা শুরু করে দিতে পারে।
ইউক্রেনে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে ইউরোপকে পালটা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে রাশিয়া। রাশিয়া বলছে, রুবলে পরিশোধ না করলে তেল সরবরাহ করবে না। বাংলাদেশে রূপপুরের অর্থ পরিশোধেও রুবলের শর্ত দিচ্ছে। কিন্তু ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় রুবল কিংবা ডলার কোনো মাধ্যমেই লেনদেন করতে পারছে না বাংলাদেশ। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ায় অর্থ পাঠানোর কোনো অ্যাকাউন্টও কার্যকর নেই। ফলে অর্থ পরিশোধে জাটিলতার জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়। কমিশন বৈঠকে এ কারণে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চায় না বাংলাদেশ। পৃথক বৈঠক করে আলোচনা করা যায়।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: