মধ্যস্থতা করবে না কাতার, দোহায় হামাসের কার্যালয়ের কী হবে?
প্রথম নিউজ, অনলাইন: গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তির আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা থেকে আপাতত সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার।
তবে দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ইসরাইল ও হামাস আন্তরিকতা দেখালে তারা আবারও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ফিরতে রাজি আছে।
এছাড়া দোহা থেকে হামাসের কার্যালয় তুলে দেওয়ার বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে কাতার।
এর আগে এক বিবৃতিতে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে একটি চুক্তির বিষয়ে শেষবার প্রচেষ্টা চালানোর ১০ দিন আগে সবপক্ষকে অবহিত করা হয়েছিল যে ওই দফায় চুক্তির বিষয়ে সম্মত না হতে পারলে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেবে কাতার।
সেখানে আরও বলা হয়েছে, হামাস-ইসরাইল উভয়পক্ষ নির্মম যুদ্ধের অবসান ঘটানোর বিষয়ে সদিচ্ছা ও গুরুত্ব দেখালে কাতার ওই মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা আবারও শুরু করবে।
এক যুগ আগে ২০১২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনের অনুরোধে রাজধানী দোহাতে হামাসকে রাজনৈতিক কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিল কাতার।
শনিবার বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে চুক্তিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে দোহায় সশস্ত্র গোষ্ঠীটির রাজনৈতিক কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে কাতার।
এমন একটি সময় কাতার এই ঘোষণা দিলো যখন সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের বিরুদ্ধে গাজা যুদ্ধ অবসানের নতুন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অভিযোগ তুলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় কাতারে হামাসের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি আর মেনে নেওয়া হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তারা।
তবে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঠানো বিবৃতিতে অবশ্য জানানো হয়েছে, দোহায় হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয় বন্ধের খবরটি সঠিক নয়। হামাসের পক্ষ থেকেও একই কথা জানানো হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ কাতার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশ। সেখানে একটি বড় মার্কিন বিমান ঘাঁটিও রয়েছে।
ইরান, তালেবান, রাশিয়াসহ বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনেক সূক্ষ্ম ইস্যুতে আলোচনা এবং সংলাপের ক্ষেত্রেও কাতারকে ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে বছরব্যাপী যে যুদ্ধ চলছে, সেটি থামানোর লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মিশরের পাশাপাশি কাতারও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে আসছিল। যদিও দীর্ঘ আলোচনার পরও যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ইসরাইল ও হামাস এখনও একমত হতে পারেনি।
এদিকে, আলোচনা সফল না হলেও কাতারের সঙ্গে হামাসের সম্পর্কের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত জুলাই মাসে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার পর দোহায় তিন দিনের শোকসভা করেছিল ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
কিন্তু সম্প্রতি হামাসের আরেক নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, দোহায় একটি ছোট হলে কেবল দুই ঘণ্টার জন্য শোকসভা করতে পেরেছে তারা।
গত বছরের শেষদিকে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই যুদ্ধবিরতির বিষয়ে পক্ষ দু’টির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে কাতার।
সর্বশেষ গত অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় এই বিষয়ে ইসরাইল ও হামাসকে আলোচনার টেবিলে বসায় কাতার। কিন্তু সেখানে হামাস স্বল্পমেয়াদী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
ফলে কাতারের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে যুদ্ধবিরতির আলোচনা যেন পুরোপুরি ভেস্তে না যায়, সেজন্য দোহায় হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয়টি থাকছে বলে জানিয়েছে দেশটি।
নিজেদের এক বিবৃতিতে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দোহায় হামাসের কার্যালয়ের বিষয়ে গণমাধ্যমের খবরগুলো সঠিক নয়। কার্যালয়টির মূল লক্ষ্য হলো যোগাযোগের একটি চ্যানেল হওয়া, যা (আগেও) যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তের বিষয়ে ভূমিকা রেখেছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে আকস্মিক হামলা চালায় হামাস। এতে অন্তত এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। এছাড়া ইসরাইল থেকে দুই শতাধিক মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাসের সদস্যরা। মূলত এরপর গাজায় অব্যাহতভাবে হামলা চালিয়ে আসছে ইসরাইল।
এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা এ হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৩ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আহত লাখেরও বেশি মানুষ, যাদের প্রায় ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
কাতারের যত মধ্যস্থতা
মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো দেশ নিজেদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুলে ধরতে চায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মিশর, ওমান ও কুয়েত। তবে এদের ছাপিয়ে ওই অঞ্চলে কাতারই সংকট সমাধান এবং আলোচনার উদ্যোক্তা দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইউক্রেন থেকে শুরু করে লেবানন, সুদান, ইরান, আফগানিস্তানসহ গাজা সংকটে মধ্যস্থতা করেছে কাতার।
এর আগে ২০১৭ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় ইরাকে আটক জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে সমঝোতায় সাহায্য করেছে কাতার। অবশ্য ওই জিম্মিদের মধ্যে কাতারের ক্ষমতাসীন পরিবারের কয়েকজন সদস্যও ছিলেন।
এছাড়া ২০১৯ সালে আফগানিস্তানের তালেবানদের হাতে আটক দুই জন পশ্চিমা জিম্মির মুক্তিতে মধ্যস্থতা করে কাতার। তালেবানরা ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পর হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়েও ভূমিকা রাখে কাতার। আর চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে বন্দী বিনিময়েও কাজ করে দোহা।
কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের আল-উদেইদ ঘাঁটি আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহারের সময় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। একইসঙ্গে কাতার তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে সমঝোতা আলোচনায় স্বাগতিক দেশ হিসেবেও কাজ করেছে। এক দশক আগে ২০১৪ সালেও গাজায় ইসরাইলি সংঘাতের সময়ে মধ্যস্থতা করেছিল কাতার।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ছোট দেশ হলেও তরল গ্যাস সমৃদ্ধ ধনী এই দেশটি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে, একইসঙ্গে প্রতিবেশী দুই বড় দেশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছে। যার কারণে, সংঘাতের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হতে চেয়েছে দেশটি।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক লেখক ও গবেষক আতেফ আল-শায়ের বিবিসি বাংলাকে বলেন, কাতার এরইমধ্যে বিশ্বের বেশ কিছু ঘটনায় যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে সফলভাবে মধ্যস্থতা করেছে। বিশেষ করে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বন্দী বিনিময়ে কাতার ভূমিকা পালন করেছে।'
আমেরিকান ও তালেবানদের মধ্যে মধ্যস্থতায়ও কাতার সফল হয়েছে। ফলে মধ্যস্থতাকারী দেশ হিসেবে কাতার আসলেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তিনি বলছেন, মানবিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংকট সমাধানে কাতার গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সংঘাতে যুক্ত থাকা দুই পক্ষের ব্যক্তিরাই কাতারে রয়েছে। আর কাতার নিজেও এই ভূমিকায় নিজেকে তুলে ধরতে চায়।
‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব?’
শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানি ১৯৯৫ সালে কাতারের আমির হওয়ার পর থেকে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে নিজেকে মধ্যস্থতাকারীর জায়গায় প্রতিষ্ঠা করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলো যেসব ‘রাষ্ট্র নয় এমন সত্ত্বা’ যেমন বিভিন্ন আদিবাসী ও সশস্ত্র-বাহিনী যাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত নয়, এমন সব প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করে কাতার।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব গোষ্ঠীর তালিকায় যুক্ত হয়েছে আফগানিস্তানের তালেবান, সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী, হামাস ও ফিলিস্তিনের অন্যান্য সংগঠন যেমন ইসলামিক জিহাদ।
বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) তথ্য মতে, কাতারে আশ্রয় নিয়েছেন হামাসের শীর্ষ নেতা খালেদ মাশাল যিনি ১৯৯৭ সালে জর্ডানে ইসরাইলি হত্যাকাণ্ডের প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যান। এছাড়া হামাসের সুপ্রিম লিডার ইসমাইল হানিয়েহ কাতারে বাস করেছেন।
ইরানের সঙ্গেও কাতারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কয়েক বিলিয়ন ডলারের যৌথ প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে তাদের।
গত কয়েক দশকে এ ধরনের সম্পর্ক কাতারকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে গেছে, যেখান থেকে দেশটি এই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ইসরাইলের চুক্তির বিষয়ে মধ্যস্থতা করে থাকে। দুই পক্ষের হয়েই চুক্তির বিষয়ে দর কষাকষি করে এই দেশটি।
এই অবস্থানকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ‘সবার বন্ধু, কারও বন্ধু নয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।