মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান

সিএনএনের রিপোর্ট

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: ইসরাইল ও হামাসের মধ্যেকার যুদ্ধ এরইমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। ফলে স্থানীয় ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে একটি সংঘর্ষ দিন দিন অনিবার্য হয়ে উঠছে। মধ্যপ্রাচ্যে এখন যে ধরনের লড়াই দেখা যাচ্ছে তা অনেকটা ছোট ধরনের হামলা ও এর পালটা হামলা। ইরান সমর্থিত যোদ্ধা সংগঠনগুলো ও মার্কিন সেনাবাহিনীর মধ্যে এসব লড়াই চলছে। এছাড়া ইসরাইলকে টার্গেট করছে ইরানপন্থি বাহিনীগুলো। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি সরাসরি যুদ্ধও দিন দিন ঘনিয়ে আসছে।

এতদিন পর্যন্ত ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি একে অপরের মুখোমুখি যুদ্ধ এড়িয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেন, সিরিয়া এবং ইরাকে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলিকে আক্রমণ করেছে। অপরদিকে ইরান-সম্পর্কিত গোষ্ঠীগুলি ইরাক এবং সিরিয়ায় মার্কিন ঘাটিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। তেহরানও ইরাক, সিরিয়া ও পাকিস্তানে ইরানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে শায়েস্তা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। সম্প্রতি ইরানে পালটা হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানও। ইরান দীর্ঘদিন ধরেই তার চারদিকে মার্কিন বাহিনীর ঘাঁটি স্থাপনের বিরোধিতা করে আসছে।

ইরান মধ্যপ্রাচ্যকে নিজের উঠোন বলে মনে করে। গত কয়েক দশক ধরে ইসলামপন্থি, পশ্চিমা-বিরোধী এবং ইসরায়েল-বিরোধী বহু বাহিনী গড়ে তুলেছে ইরান। দেশটি এই পুরো নেটওয়ার্ক তৈরি করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। তারাই এসব বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, তহবিল এবং অস্ত্র দেয়। এই গোষ্ঠীগুলি সাম্প্রতিক সময়ে আরও সক্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক জলপথে জাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্ত করছে। এতে পশ্চিমা দেশগুলোর বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিজেদের অর্থনীতি বাঁচাতে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলি ইয়েমেনে আক্রমণ করেছে। ইরান গাজার হামাসকেও অর্থায়ন করে। এই বাহিনী গত ৭ই অক্টোবর ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়েছিল। এতে ১২০০ ইসরাইলি নিহত হয়। 

হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের আগেই মধ্যপ্রাচ্যে ৩০ হাজার মার্কিন সেনা উপস্থিত ছিল। যুদ্ধ শুরুর পর আরও ১২০০ সেনা পৌঁছেছে সেখানে। সাথে মধ্যপ্রাচ্যের কাছাকাছি মোতায়েন করা হয়েছে আরও দুই হাজারের বেশি সেনা। ইরাক ও সিরিয়ায়ও আছে মার্কিন সেনারা। এতে ইরানকে ভালোভাবেই চাপে রাখতে পারছে দেশটি। তবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অংশে নিজেদের বাহিনীকে শক্তিশালী করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান উভয়ই।

এরমধ্যে লেবাননে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী আধাসামরিক বাহিনী রয়েছে। সেখানে আছে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ। গোষ্ঠীটির প্রধান ঘাঁটি ইসরাইল-লেবানন সীমান্তে অবস্থিত। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইলের সাথে গুলি বিনিময় করেছে লেবানন। এই বাহিনীর কাছে ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। আছে প্রচুর রকেট ও মর্টার। তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ অনুসারে, এই শত শত ক্ষেপণাস্ত্র অত্যন্ত নির্ভুল এবং অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক। হিজবুল্লাহ নেতা সাইয়্যেদ হাসান নাসরাল্লাহ দাবি করেছেন যে, গোষ্ঠীটির এক লাখের বেশি সক্রিয় সৈন্য রয়েছে। ইরানই হিজবুল্লাহর প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ।

লেবানন ছাড়াও ইরাকে সক্রিয় আছে প্রচুর ইরানপন্থী বাহিনী। ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড কর্পস বা আইআরজিসি ঘনিষ্ঠভাবে এসব শিয়া যোদ্ধা গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন করে আসছে। এছাড়া আরও কিছু স্থানীয় বাহিনী রয়েছে যাদের ওপর তেহরানের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কাতাইব হিজবুল্লাহ, হারাকাত আল-নুজাবা এবং কাতাইব সাইয়্যদি আল-শুহাদা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, কাতাইব হিজবুল্লাহর মতো কিছু বাহিনী বাগদাদের থেকেও তেহরানের প্রতি বেশি অনুগত। ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরের মার্কিন অফিস বিশ্বাস করে যে, এই বাহিনীর ১০ হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো ইরাকে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে কয়েক ডজন হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও এর পালটা জবাব দিয়েছে। তবে সম্প্রতি ইরাকের আল-আসাদ বিমান ঘাঁটিতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মার্কিন কর্মীরা আহত হন। 
২০০৮ সাল পর্যন্ত ইরাকে এক লাখ ৬০ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছিল। তবে এখন এরবিল এবি, আল-আসাদ এবি এবং বাগদাদের জেওসি-ওয়ান ঘাঁটি সহ বেশ কয়েকটি ঘাঁটিতে সব মিলিয়ে ২৫০০ মার্কিন সেনা মোতায়েন আছে। তবে এই মার্কিন সেনাদেরও মানতে পারছে না ইরাক। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রকে তার সেনা সরিয়ে নিতে বলেছে। 

ইরাকের প্রতিবেশি দেশ সিরিয়াতেও ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে ইরানের। সেখানে সক্রিয় আছে ইরানের আইআরজিসি বাহিনীর এলিট ইউনিট কুদস ফোর্স। ২০১১ সাল থেকেই সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে চলমান চক্রান্ত থামাতে নিয়োযিত রয়েছে ইরানি সেনারা। ইরানি কর্মকর্তারা আসাদের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করে এবং প্রায়ই ফ্রন্টলাইনে আসাদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়। এছাড়া সিরিয়ায় থাকা ইরানপন্থী বাহিনীগুলোকেও পরিচালনা করে তারা। সিরিয়ায় আছে জাইনাবিউন ও ফাতেমিয়ুন নামের দুটি শিয়া বাহিনী। তবে এই বাহিনীতে থাকা সদস্যরা আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে গিয়েছে। 

অপরদিকে সিরিয়ায় মার্কিন সেনার সংখ্যা ৮০০ জনের মতো। মূলত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তারা। বেশিরভাগ মার্কিন সেনাদের পূর্ব সিরিয়ায় মোতায়েন রাখা হয়েছে। সেখানে তারা আসাদবিরোধী ‘সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সকে’ (এসডিএফ) সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া সিরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সক্রিয় আসাদবিরোধী আরেকটি বাহিনী ‘সিরিয়ান ফ্রি আর্মি’কেও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের শত্রু এবং আক্রমণকারী হিসেবে বিবেচনা করে সিরিয়ার সরকার। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সিরিয়ায় থাকা মার্কিন সেনাদের ওপর ব্যাপক হামলা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব হামলার পেছনে আছে ইরান। 

ইরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান প্রক্সি যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। তারা লোহিত সাগরে একাধিক পশ্চিমা জাহাজে হামলা চালিয়েছে। দলটির দাবি, তারা গাজায় যুদ্ধের জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিচ্ছে। গোষ্ঠীটি বর্তমানে উত্তর ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর আগে প্রায় আট বছর ধরে সৌদি আরবের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে তারা। হুথিদের অস্ত্রগুলি মূলত ইরান থেকে আসে। ইরান দেশটিতে অস্ত্রের বিভিন্ন অংশ পাঠায়। সেগুলিই সামান্য মোডিফিকেশনের পর একসঙ্গে করে ব্যবহার করে হুথিরা। বর্তমানে মার্কিন সামরিক বাহিনী ইয়েমেনের উপকূলে লোহিত সাগরে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। সেখান থেকে তারা হুথিদের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছে। 

ইরানপন্থী আরেকটি বাহিনী হচ্ছে গাজার হামাস। ইসরাইল বিশ্বাস করে যে, চলমান যুদ্ধের আগে হামাসের প্রায় ৩০ হাজার যোদ্ধা ছিল। এটি একটি ইসলামিক সংগঠন যার একটি সামরিক শাখা রয়েছে। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হামাস। গত ৭ই অক্টোবর ইসরাইলে হামলা চালায় হামাস। এতে ১২০০ ইসরাইলি নিহত হয়। এছাড়া আরও ২৫৩ ইসরাইলিকে অপহরণ করে আনে এই বাহিনী। ইরান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হামাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। সাধারণত তেহরানের অন্যান্য মিত্ররা শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাস করে। তবে হামাস একটি সুন্নি মুসলিম সংগঠন।

যদিও কোনো প্রমাণ নেই যে ইরান ৭ই অক্টোবরের হামলার নির্দেশ দিয়েছে। তবে ইসরাইল এ জন্য ইরানকে দায়ী করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে যে, ইরান ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলিকে বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে। হামাস ছাড়াও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ  বা পিআইজেকেও সহায়তা করে ইরান।