মে-জুনে ‘অলআউট’ কর্মসূচিতে বিএনপি

মে-জুনে ‘অলআউট’ কর্মসূচিতে বিএনপি
মে-জুনে ‘অলআউট’ কর্মসূচিতে বিএনপি

প্রথম নিউজ, অনলাইন : সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে আছে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোট। আপাতত জনসম্পৃক্ত ইস্যুসহ দশ দফা দাবিতে চলমান এই আন্দোলন আরও এগিয়ে নিতে চায় বিএনপি। যাকে নেতারা আন্দোলনের রুটিন কর্মসূচি বলছেন। এরপর ‘অলআউট’ কর্মসূচিতে যাবেন। এজন্য রোজার ঈদ ও কুরবানি ঈদের মাঝামাঝি সময় মে-জুনকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। এই সময়ে ঢাকা অভিমুখে রোডমার্চ, লংমার্চের মতো কঠোর কর্মসূচি দিয়ে সফলতা ঘরে আনতে চায়। এজন্য চার মাসব্যাপী কর্মসূচির রোডম্যাপ করা হয়েছে। যা এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের হাতে রয়েছে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘কর্মসূচি চলছে। আরও কর্মসূচি আসবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জনগণের দুর্ভোগ মোচন এবং দেশ ও দেশের জনগণকে দুর্নীতি, অনাচার, লুট ও ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে বিএনপি। একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ দেশনেত্রী খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক কারণে আটক নেতাকর্মীদের মুক্ত করতে এ আন্দোলন। যা ক্রমান্বয়ে বেগবান হয়ে অবৈধ সরকারকে পদত্যাগে ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করবে। মানুষ প্রস্তুত হয়ে গেছে। আন্দোলনের সফলতা সময়ের ব্যাপার মাত্র।’

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘কর্মসূচিতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হামলা-বাধার পরও নেতাকর্মীরা মাঠ ছেড়ে যাননি। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নেতাকর্মীরা বেশি ঝুঁকি নিয়ে কর্মসূচি পালন করছেন। অনেক বেশি সাধারণ মানুষ অংশ নিচ্ছেন। নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের এ ধরনের সাহসিকতা বড় আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণে নীতিনির্ধারকদের উদ্বুদ্ধ করছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এ বছরের শেষের দিকে নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। মূলত বিরোধীদের আন্দোলন দমাতে এই কৌশল নেওয়া হচ্ছে। তাই আন্দোলনে থাকা বিএনপিসহ বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও দাবি আদায়ে আর সময় নিতে চায় না। আন্দোলনের মাধ্যমে মে-জুনেই এর একটি সুরাহা হবে।

জানা গেছে, মহানগরের পর উপজেলা, থানা এবং পৌরসভায় কর্মসূচি দেওয়া হবে। এরপর আবার জেলায় জেলায় কর্মসূচি শেষ করে মহানগরে কর্মসূচি পালন করা হবে। এভাবে কর্মসূচির সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে চূড়ান্ত আন্দোলনের পথে হাঁটতে চায় বিএনপি। পরে মে-জুনে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। এ নিয়ে সোমবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকেও আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরের পদযাত্রা কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে বলে মনে করেন নীতিনির্ধারকরা। বিশেষ করে মহানগরের নেতারা বিভেদ ভুলে পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। যা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এখন থেকেই চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নানা কর্মকৌশল নিয়েও আলোচনা করেন নেতারা।

এদিকে ১১ ফেব্রুয়ারির ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মসূচিও সফল হয়েছে বলে মনে করে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এতে করে নেতাকর্মীরা এখন আরও উজ্জীবিত মনে করছেন তারা। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কর্মসূচি পালনে নেতাকর্মীদের দৃঢ়তায় সন্তুষ্টি প্রকাশও করেছেন। দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, হাট, বাজার ও গ্রামে গ্রামে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাধারণ জনগণও কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। মানুষ তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে মাঠে নেমেছেন। এতে প্রমাণ হয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারবিরোধী জনমত গড়ে উঠেছে। ইউনিয়ন কর্মসূচির বিষয়ে সার্বিক মূল্যায়নও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ‘পদযাত্রা কর্মসূচি সারা দেশে ৯০ ভাগ ইউনিয়নে পালিত হয়। উপস্থিতির সংখ্যা ছিল অনেক। প্রান্তিক নেতাকর্মীদের আপনার এবং দলের প্রতি ভালোবাসা ও আবেগের কারণে কর্মসূচি সফল হয়েছে। দীর্ঘদিন পরে প্রান্তিক মানুষগুলো সরাসরি দলের স্লোগান শুনেছে।’

সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিভাগীয় ও মহানগর কর্মসূচিতে সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের আরও আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করার বিষয়েও একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, বিভিন্ন জেলায় সিনিয়র নেতাদের সমন্বয় না করার কারণে উপস্থিতি কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিটা বিভাগের সিনিয়র নেতাদের সম্মান না দেখানো এবং কর্মসূচিতে তাদের উপস্থিতি কৌশলে নিরুৎসাহিত করার মনোভাব দেখা যাচ্ছে। এছাড়া জেলা নেতাদের দ্বন্দ্বে একটি পক্ষ হয়ে যাওয়ার মতো মনোভাবও দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকজন সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকের। বিষয়গুলো দৃশ্যমান লক্ষণীয় উল্লেখ করে বেশ কয়েকটি মহানগর ও জেলায় এমন কর্মকাণ্ডের বিষয় তুলে ধরা হয়।

বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের উপজেলা, পৌর কমিটি দীর্ঘ চার বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে আহ্বায়ক কমিটি হলেও সেগুলোর কার্যক্রম বা পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার উদ্যোগ নেই। বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের পদবিহীন নেতারা বেশি কর্মসূচিতে সক্রিয় এবং অংশগ্রহণ করছে। অথচ কিছু কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন, যারা নিজেদের পক্ষে কমিটি ভাগিয়ে নিয়েছেন। তারা শুধু ছবি দেখাতে ক্ষণিকের জন্য কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। পরে সেই ছবি তুলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন। অথচ বিভাগীয় কর্মসূচিতে সাড়ে তিন বছর যারা কমিটিতে বঞ্চিত হয়েছেন তারা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সর্বাধিক লোক নিয়ে বিভাগীয় কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়েছিল। তবে তাদের দল থেকে ধন্যবাদপত্র পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। অথচ যারা কর্মসূচিতে ফাঁকি দিয়েছে তাদের অনেকেই ধন্যবাদপত্র পেয়েছেন। এতে নেতারা অনেকেই হতাশ হয়েছেন। কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার আগে এসব বিষয়েও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি দিতে হবে।

চলতি মাসে যৌথ ঘোষণাপত্র, ৭ দফা খসড়া তৈরি : অভিন্ন দফা প্রণয়নে গত মাসে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এবং গণতন্ত্র মঞ্চের জোনায়েদ সাকি ও হাসনাত কাইয়ুমকে যৌথ ঘোষণাপত্র তৈরির জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা দফায় দফায় বৈঠক করে সাত দফার একটি যৌথ ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেছে। যা যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জোট ও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আরও সংযোজন-বিয়োজন করা হতে পারে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরলে এই ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা হবে। খসড়ায় উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত করে সরকারকে পদত্যাগ, অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য দলনিরপেক্ষ/নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল করে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোটের সুস্থ ব্যবস্থা নিশ্চিত, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার প্রবর্তন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার যৌক্তিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। খসড়ায় আরও আছে পরপর দুবার প্রধানমন্ত্রী পদে কেউ আসীন হবে না, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নিপীড়নের অংশ হিসেবে সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর সাজা বাতিল, সব হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও সব রাজনৈতিক কারাবন্দির অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব নির্যাতনমূলক আইন বাতিল, গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে এর আগে সংঘটিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুনের যথাযথ তদন্ত এবং দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিগত বছরগুলোতে বিশেষ করে ১৫ বছর ধরে বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, শেয়ার মার্কেট, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি ও এর দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করতে শক্তিশালী কমিশন গঠনসহ এসব অপরাধে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নারীর অধিকার এবং সব ধর্ম, জাতি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাগরিক মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিত করার নীতি প্রতিষ্ঠা, জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সমতা, ন্যায্যতা, পারস্পরিক স্বার্থের স্বীকৃতি এবং স্বীকৃত আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: