বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর বিশাল তাৎপর্যময়

সফরকারী কোনো বিদেশি নেতাকে সর্বোচ্চ যে কূটনৈতিক প্রটোকল দেয়া হয়, তাই দেয়া হচ্ছে তাকে। বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউজে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো হবে তাকে।

বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর বিশাল তাৎপর্যময়

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তাল অবস্থার মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর বিশাল তাৎপর্য বহন করে। তাকে স্বাগত জানাতে সব রকম প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে নিয়েছে হোয়াইট হাউস। এটি মোদির রাষ্ট্রীয় সফর। সফরকারী কোনো বিদেশি নেতাকে সর্বোচ্চ যে কূটনৈতিক প্রটোকল দেয়া হয়, তাই দেয়া হচ্ছে তাকে। বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউজে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো হবে তাকে। এরপর তিনি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসবেন। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। এদিনই দেয়া হবে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজ। 

এতে বিভিন্ন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা (সিইও) উপস্থিত থাকবেন। মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষের অধিবেশনে ভাষণ দেবেন মোদি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনিদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। এসব আয়োজন করা হয়েছে এমন একজন নেতার জন্য, যার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র একসময় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। বর্তমানে মোদিকে একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। সতর্কতার সঙ্গে আলোচনার বিষয় খসড়া করা হয়েছে। এতে শুধু ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে জ্বালানি সম্পর্কের বিষয়ই থাকবে এমন নয়। একই সঙ্গে বৈশ্বিক শৃংখলার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন বিষয়ও থাকবে। 

অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে ঠিক এই মুহূর্তে ইন্দো-প্যাসিফিকে ভারতের প্রভাব সম্ভবত খুব বেশি প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ক্ষেত্রে ভারতকে ভারসাম্য হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু নিজেদের গায়ে এই ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে দেয়ায় কখনোই পুরোপুরি স্বস্তিতে নেই দিল্লি। এমনটা করতে তারা এখনও অনিচ্ছুক হতে পারে। কিন্তু ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অনুঘটক হিসেবে রয়ে গেছে চীন। 

তা সত্ত্বেও চীন ক্ষিপ্ত হতে পারে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হয়নি ভারত। গত বছর তারা উত্তরাখণ্ড রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে সামরিক মহড়া করেছে। উত্তরাখণ্ড হলো চীন সীমান্তের সঙ্গে হিমালয়ান এলাকা। বেইজিংয়ের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও কোয়াডে অব্যাহতভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে দিল্লি। এতে আরও আছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। বৈশ্বিক মঞ্চে এখন সময়টা ভারতের, এ কথা বলার মতো দৃঢ় কূটনীতি আছে ভারতের। এর ভাল কারণও আছে। এই মুহূর্তে বিশ্বে অর্থনীতির উজ্বল যে অল্প কয়েকটি স্থান আছে, তার মধ্যে ভারত অন্যতম। ভূ-রাজনীতিও তার পক্ষে আছে। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বেশির ভাগ দেশই উৎপাদনের দিক দিয়ে চীনের বিকল্প কোনো দেশকে প্রত্যাশা করে। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বিশাল বাজার আছে ভারতে। বিভিন্ন দেশ এবং বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এই বাজার হতে পারে চীন প্লাস ওয়ান পলিসির একটি উত্তম বিকল্প। 
ওয়াশিংটন ডিসির ব্রকিংস ইনস্টিটিউশনের দ্য ইন্ডিয়া প্রজেক্টের পরিচালক তানভি মাদান বলেন, ভারত এখন কি করছে এবং চীন সম্পর্কে প্রকাশ্যে যা বলছে না, সেটাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। 

তিনি আরও বলেন, দিন শেষে ভারত তার গায়ে প্রকাশ্যে ‘ট্যাগ’ লাগাক বা না লাগাক, এটা পরিষ্কার যে- চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আমলে নিচ্ছে ভারত সরকার। ওয়াশিংটনের আরেক থিংক ট্যাংক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান যোগ করেন, ইন্দো-প্যাসিফিক দৃশ্যপটে বিস্তৃতভাবে চোখে চোখ রেখে দেখা শুরু করেছে এই দুই দেশ। 

ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পশ্চিমা উপাদানের (কম্পোনেন্টস) গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করছে বলে আমরা দেখতে শুরু করেছি। অনেক বছর ধরে যৌক্তিক কারণে ভারতের প্রধান উদ্বেগ ছিল ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে প্যাসিফিক এবং দক্ষিণ চীন সাগর। এখন এসব অঞ্চলে সামুদ্রিক নিরাপত্তা দেখবে তারা। দুই দেশ যে যৌথ বিবৃতি দেবে, তাতে সরাসরি চীনের কথা উল্লেখ নাও থাকতে পারে। কিন্তু দুই নেতা ইন্দো-প্যাসিফিকে তাদের উপস্থিতি সংহত করা নিয়ে যখন আলোচনা করবেন, তখন এটিই হবে এজেন্ডার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা চীনের বিষয়ে একমত হলেও ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে ভিন্ন মত দেখাতে পারে দুই দেশ। 

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরাসরি রাশিয়ার সমালোচনা করেনি দিল্লি। বিশ্লেষকরা বলেন, রাশিয়া থেকে প্রতিরক্ষা খাতে আমদানির জন্য ভারত খুব বেশি নির্ভরশীল এবং মস্কোর সঙ্গে তাদের পরীক্ষিত সম্পর্ক আছে।  প্রতিরক্ষা চাহিদার শতকরা প্রায় ৫০ ভাগের জন্য মস্কোর ওপর নির্ভর করে ভারত। কিন্তু এটাই মূল কারণ নয়। জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে সব সময় ভারত গর্বিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একে বলা হয় কৌশলগত নিজস্ব অবস্থান। বৈশ্বিক ব্যবস্থায় একটি সুনির্দিষ্ট শক্তির সঙ্গে আবদ্ধ থাকতে চায় না তারা। 

এ জন্য ইউক্রেন আগ্রাসনের প্রথমদিকের কয়েক মাসে ওয়াশিংটনের কূটনীতিকরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন।  তবে কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান শিথিল করেছে। রাশিয়া থেকে ভারত যে অব্যাহতভাবে অশোধিত তেল কিনছে, যুক্তরাষ্ট্র তা না দেখার ভান করছে। প্রকাশ্যে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ভারতও একধাপ এগিয়ে গেছে। মিসেস মাদান বলেন, রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে ভারতের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলেনি। 

দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার চেইন হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। ‘ইনিশিয়েটিভ অন ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড ইমার্জিং টেকনোলজি’তে উভয় দেশই স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় আইটি, মহাকাশ, প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করবে। দুই দেশের নেতারা প্রযুক্তি, বিশেষত সেমি কন্ডাক্টর প্রস্তুত করা নিয়ে আরও সহযোগিতার ঘোষণা দিতে পারেন। এই সেমি কন্ডাক্টরের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী হলো চীন। 

কিছু সংবাদ শিরোনাম হওয়ার মতো চুক্তি হবে অপরিহার্যভাবে। তা সত্ত্বেও ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক সব সময়ই জটিল হয়েছে। এর কারণ, কয়েক দশক ধরে তাদের মধ্যে আস্থার সংকট। তা মাঝে মাঝে উত্তেজনাকর অবস্থায় যায়। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দৃশ্যত স্থির সংকল্পবদ্ধ। তার দেশ মোদির অধীনে মানবাধিকারের রেকর্ড নিয়ে প্রশ্ন তুললেও দুই দেশের মধ্যে একটি উজ্বল সম্পর্ক প্রত্যাশা করে। 

মোদির সফরের প্রাক্কালে কংগ্রেসের ৭৫ জন ডেমোক্রেট সদস্য মানবাধিকার ইস্যু তুলে ধরেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে। ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং মিডিয়ায় বিধিনিষেধের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।