বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প ত্রুটিপূর্ণ

বিশেষায়িত বাস না কিনে সাধারণ বাস চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার প্রস্তাব

বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প ত্রুটিপূর্ণ

প্রথম নিউজ, ঢাকা: বাংলাদেশের প্রথম বিআরটি প্রকল্প বিমানবন্দর-গাজীপুরে যোগাযোগ ব্যবস্থায় কতটা স্বস্তি আনতে পারবে তা নিয়ে ইতোমধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রায় সাড়ে চার হাজারের কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ মাহাসড়কে যানজটের আয়োজন চলছে বলে উল্টো আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও প্রকল্প শুরু হওয়ার পর গাজীপুর তথা উত্তরাঞ্চলের যাত্রীদের ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়তে হয়।

গাজীপুর-বিমানবন্দর ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বাস্তবায়িত এ ধরনের প্রকল্পের চেয়ে ৬ গুণ বেশি সময় চলে গেলেও এখনো কাজ শেষ হয়নি। শুধু তাই নয়, ব্যয়ের ক্ষেত্রেও শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে প্রকল্পটি। এমন দৈর্ঘ্যরে বিশ্বের অন্য বিআরটির প্রকল্পের চেয়ে ৪ গুণের বেশি ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সময় ও ব্যয়ের দিক থেকে ইতোমধ্যেই প্রকল্পটি এক রকম ‘বিশ্ব রেকর্ড’ করেছে-এমন মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সময় ও ব্যয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়লেও এর সফলতা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। 
 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিআরটি প্রকল্পটি শুরু হলে  ঢাকা মহানগরী, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নরসিংদীর যাত্রীদের পাশাপাশি রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের অন্তত ২৫ জেলার যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়বে। বিআরটি প্রকল্পের সুবিধা শুধুমাত্র ঢাকা-গাজীপুর রুটের যাত্রীরা ভোগ করবে। এর বাইরে আঞ্চলিক বাসসহ ২৪ জেলার বাস চলবে নিচের সড়ক দিয়ে। এতে আবারও যানজটে থমকে যেতে পারে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে।

তারা বলছেন, নির্মাণ কাজের কারণে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত মহাসড়ক সরু হয়ে হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও মূল সড়কের অর্ধেক অংশে যান চলাচল করছে। প্রকল্পের ফ্লাইওভারগুলো উন্মুক্ত থাকায় এখন যানজট তুলানমূলক কম। তবে বিআরটি লেনে ডেডিকেটেড বাস চলাচল শুরু হলে দুই পাশের সড়কে গাড়ির চাপ বাড়বে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের সচিব পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, এত বড় একটি মহাসড়কের ফুটপাথ কোথায় থাকবে? ফুটপাথ না থাকলে শ্রমিক অধ্যুষিত এই এলাকার মানুষজন হাঁটবে কোথায়? এমন জনবহুল ও ব্যস্ত সড়কে বিআরটি প্রকল্প এভাবে হয় না। আমার মনে হয় অদূর ভবিষ্যতে এই প্রকল্প টেকসই হবে না। তাই এখনই বিকল্প সমাধান খোঁজে বের করা উচিত। 

তিনি বলেন, এই সড়েকর পাশে সিটি করপোরেশনের ড্রেনের লাইন। ড্রেন বা সড়কের সংস্কার কাজ প্রয়োজন হলে গাড়ি চলবে কীভাবে? বিআরটির করিডোর বাদ দিলে যে জায়গা থাকে তা দিয়ে দুটি গাড়ি একসঙ্গে ভালোভাবে চলাচল করতে পারবে না। 

গাজীপুরের দুজন সংসদ সদস্য সাংবাদিকদের সঙ্গে আলপাপকালে বলেন,আমাদের মতামত উপেক্ষা করে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটি এখানে কেন করা হলো, কার স্বার্থে করা হলো তা বুঝতে পারছি না। তারা বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আগের চেয়ে বেশি যানজট হবে। ফলে স্থবির হয়ে যেতে পারে পুরো গাজীপুর। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে এসব বলতে পারি না। কিন্তু নিজের কাছে খারাপ লাগে। মানুষ ভোট দিয়েছে, কয়দিন পর গালাগালি করবে।

গাজীপুর জেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান সরকার রাসেল বলেন, সরকার প্রকল্পটি নিয়ে এক যুগ আগে পরিকল্পনা করেছিল। এই সময়ে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, গাড়ির সংখ্যাও বেড়েছে। সামনের সময়গুলোতে আরও বাড়বে। বিআরটি চালু হলে কি হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে বাস মালিকরা যানজটের আশঙ্কা করছেন। 

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন গাজীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসান ইউসুফ খান বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এ প্রকল্প নিয়ে নানা কথা বলা হচ্ছে। মূল সড়কের মাঝখানে করিডোরের জন্য জায়গা কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই যানজট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমরা আশা করব গাজীপুরসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের মানুষের যাতায়াতের কথা মাথায় রেখে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ও গাজীপুর ১ আসনের সংসদ সদস্য আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক বলেন, আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না। তবে আমি মনে করি বিআরটি প্রকল্প চালু করতে হলে পুরোটাই যেন ফ্লাইওভার করে দেওয়া হয়। এতে নিচের সড়কে চাপ কিছুটা কমবে। এর বিকল্প এই মুহূর্তে কিছু আছে বলে আমরা মনে হয় না। 
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, বিমানবন্দর-জয়দেবপুর বিআরটি খণ্ডিত ও ত্রুটিপূর্ণ। এরপরও পুরো সড়ক গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর যানজট থেকে স্বস্তি মিলেছে। কিন্তু এখানে ডেডিকেটেড বাস চলাচল শুরু হলে পরিবহন পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হবে। আবার যানজট বাড়বে। এ এলাকার শিল্পাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

তিনি বলেন, এই করিডোরের জন্য বিশেষায়িত বাস না কিনে সাধারণ বাস চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে ভালো হবে। এ প্রকল্পের জন্য বাস কিনলে পুরো টাকা গচ্ছা যাবে। তিনি আরও বলেন, সরকারের এই উদ্যোগকে বিআরটি না ভেবে এখন যদি করিডোর উন্নয়ন চিন্তা করা হয়, তাহলে তা সফল হবে। এভাবে মনে করতে হবে, একটি অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে, সেখানে কিছু ক্ষতি হয়েছে। বিআরটির নামে খণ্ডিত ও ত্রুটিপূর্ণ বিআরটিতে বাস চালালে আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়বে সরকার। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, হাইওয়েগুলোর আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে, সেখানে সাধারণত দ্রুত গতিতে গাড়ি চলাচল করার কথা। কর্তৃপক্ষেরও উচিত হাইওয়েতে সে অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণ করা। হাইওয়ের কোনো এক জায়গায় যানবাহন বাধাগ্রস্ত হলে পুরো সড়কেই তার চাপ পড়বে।

তিনি বলেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ মাহাসড়কের বিআরটি প্রকল্প এলাকায় কোনো এক জায়গায়ও যদি সড়ক সংকীর্ণ থাকে এর প্রভাবে যানজট তৈরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংকীর্ণ জায়গা জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে প্রশস্ত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. এসএম সালেহ উদ্দিন বলেন, বিশ্বের কোথাও বিআরটি প্রকল্পের জন্য ফ্লাইওভার নির্মাণ করে না।