পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে একে অন্যকে দোষারোপ
রোববার মতিঝিলে এফবিসিসিআই ভবনে নিত্যপণ্যের মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা উঠে এসেছে। এফবিসিসিআই আয়োজিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি জসিম উদ্দিন।
সভার শুরুতে এফবিসিসিআই’র জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু নিত্যপণ্যের মজুত পরিস্থিতি তুলে ধরে তেল-চিনি কেন সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না, তা জানতে চান। এরপর পুরো সভায় এক পক্ষ দাম বৃদ্ধির পেছনে অন্য পক্ষকে দায়ী করে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, গত ১৮ বছর ধরে ভোজ্যতেল-চিনি পাইকারি ব্যবসা করি। ব্যবসার শুরুতে রোজায় সময় এ দুটি পণ্যের যে চাহিদার কথা শুনেছি, এখনো সেই চাহিদার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ পরিসংখ্যান পরিবর্তন হয়নি। এত দীর্ঘসময় কী দেশে জনসংখ্যা বাড়েনি? দাম নিয়ন্ত্রণে সঠিক চাহিদা নির্ধারণ জরুরি। তিনি আরও বলেন, এক লাখ ব্যবসায়ীর পক্ষে কখনো ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ২ টাকা বাড়ানো সম্ভব নয়। ৪-৫ মিল মালিক চাইলে দাম বাড়াতে পারেন, আবার কমাতেও পারেন।
পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি আবুল হাশেম বলেন, দাম বাড়লেই পাইকারি ব্যবসায়ীদের কালোবাজারি অভিহিত করা হয়। মানসম্মানের ভয়ে চিনি ব্যবসাই ছেড়ে দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, চিনির দাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি মিল মালিকরা নির্ধারণ করেন। পাইকারি পর্যায়ে, খুচরা পর্যায়ে চিনির দাম কত হবে তা উল্লেখ করে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, খোলা চিনি যে দামে বিক্রি করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেই দামে মিল গেট থেকে চিনি আনতে পারেন না পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
এর জবাবে ভোজ্যতেল অ্যাসোসিয়েশন সভাপতির পক্ষে অমিত হাবিব চক্রবর্তী বলেন, রোজায় পণ্যের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ প্যানিক বায়িং (পণ্য কেনার হুলুস্থুল প্রবণতা)। এবার পর্যাপ্ত মজুত থাকায় রোজায় তেলের দাম বাড়বে না আশা করছি।
নিউমার্কেট কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বলেন, পণ্যের গায়ে লেখা দামের চাইতে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করা হয় না, করাও যায় না। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত, ভোক্তা অধিকার খুচরা ব্যবসায়ীদের সম্পূর্ণ হয়রানিমূলকভাবে জরিমানা করে। সরবরাহ ঠিক থাকলে রোজার পণ্যের দাম বাড়বে না বলে মনে করেন তিনি।
চুয়াডাঙ্গা, দিনাজপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া চেম্বারের নেতারা অভিযোগ করে বলেন, পাইকারদের কাছ থেকে চিনি কিনলেও রসিদ বা মেমো পাই না। এই স্লিপ সব সমস্যার মূল। মেমো দেখাতে না পারলে ভোক্তা অধিকার বা ম্যাজিস্ট্রেট খুচরা ব্যবসায়ীদের জরিমানা করেন। আয়কর-ভ্যাট কর্মকর্তাদের মতো ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তাদের বার্ষিক জরিমানার করার একটি টার্গেট বেঁধে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা।
এর জবাবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেন, মেমো (মিল গেট) যেখান সৃষ্টি হয়, সেখান থেকে মেমো না পাওয়ায় খুচরা ব্যবসায়ীদেরও মেমো দেওয়া হয় না। সবাই গোপনে গোপনে ব্যবসা করছে। মিল গেট থেকে যেই রেটে মেমো দেওয়া হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি টাকা ব্যাংকে জমা নিচ্ছে। সত্য কথা বললে পরদিন মিল গেটে আর ঢুকতে দেবে না। তবে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, যারাই পণ্য কিনছেন, তারা নিয়মিত ক্রয়ের রসিদ নিচ্ছেন। যিনি রসিদ পান না, তিনি তো পণ্যই নেন না। কারণ রসিদ ছাড়া পণ্য বিক্রি হয় না।
এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে গোলাম মাওলা বলেন, মিলগুলো সরকারনির্ধারিত মূল্যের রসিদ দেয় না। রসিদ দিচ্ছে এক দরে, আর টাকা নিচ্ছে অন্য দরে। একপর্যায়ে মিলগুলোর প্রতিনিধিরা বলেন, রসিদ না পেলে পণ্য কিনবেন না। এর উত্তরে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রশ্নটা রসিদ পাওয়া নিয়ে নয়, নির্ধারিত মূল্যের রসিদ পাচ্ছি কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। তখন মিলগুলোর প্রতিনিধিদের একজন বলেন, ‘তাহলে আপনারা আমাদের থেকে পণ্য নিয়েন না।’
এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, টাকা নিলে রিসিট দিতে সমস্যা কোথায়? কেউ তো আর ইয়াবা বা অবৈধ পণ্যের ব্যবসা করেন না। এ ধরনের নাটক-সিনেমার কথা আর শুনতে চাই না। ব্যবসা করলে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে থেকে ব্যবসা করতে হবে। নীতি-নৈতিকতা নিয়ে ব্যবসা করতে হবে। খারাপ কিছু মানুষ থাকতে পারে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। অল্প কিছু ব্যবসায়ীর এমন আচরণের কারণে পুরো ব্যবসায়ী সমাজের দুর্নাম হয়।
তিনি আরও বলেন, গতবার সবাই প্রতিজ্ঞা করলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হবে না। কিন্তু ঈদের দুই দিন আগে বাজার থেকে তেল হাওয়া হয়ে গেল। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে আবার বাসার খাটের নিচ থেকেও তেল উদ্ধার করেছে। এটা কীভাবে সম্ভব। এবার আমরা ঘোষণা দিতে চাই, রোজা এবং ঈদে অযৌক্তিকভাবে তেল-চিনির দাম বাড়াবেন না। ব্যবসায়ীরা শুধু মুনাফাখোর, উৎসব-পার্বণে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, এই তকমা থেকে এবার বেরিয়ে আসতে চাই।
জসিম উদ্দিন আরও বলেন, ডলার সংকটের কারণে ব্যাংক এলসি খুলতে চাচ্ছে না। এখন হুন্ডিতে ১১৫-১২০ টাকা রেটে ডলার বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। যেমন এলসি ছাড়াই বন্দরে কতগুলো গাড়ি চলে এসেছে। এ ধরনের আরও ঘটনা ঘটছে। এগুলো অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক।