ডলার সংকট: অনলাইনেও কেনাকাটা কমেছে

গত ৬ মাসে    ই-কমার্স, এফ-কমার্স (ফেসবুকভিত্তিক) বা ডিজিটাল কমার্স খাতে ব্যবসা সংকুচিত হয়েছে। বিক্রিও কমেছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ

ডলার সংকট: অনলাইনেও কেনাকাটা কমেছে
প্রথম নিউজ, অনলাইন: করোনা মহামারির সময় অনলাইন কেনাকাটায় মানুষের আগ্রহ ব্যাপকভাবে বেড়েছিল। তবে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা আর ডলার সংকটের কারণে ই-কমার্স খাতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। গত ৬ মাসে    ই-কমার্স, এফ-কমার্স (ফেসবুকভিত্তিক) বা ডিজিটাল কমার্স খাতে ব্যবসা সংকুচিত হয়েছে। বিক্রিও কমেছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চলতি বছর পরিস্থিতির উন্নতির কোনো আশা দেখছেন না তারা। কারণ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছিল, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালের ৩০শে জুনের পরে যারা পণ্য কিনতে টাকা দিয়েছিলেন, তারা সেই টাকা ফেরত পাবেন। এরপর ৫২৫ কোটি টাকা থেকে গ্রাহকরা ফেরত পেয়েছেন মাত্র ৩১০ কোটি টাকা (গত ডিসেম্বর পর্যন্ত)। বাকি ২১৫ কোটি টাকা এখনো পাননি। এই টাকা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লেনদেন পরিশোধকারী প্রতিষ্ঠানে (পেমেন্ট গেটওয়ে) আটকে আছে। এ কারণে গ্রাহকদের আস্থার সংকট এখনো কাটেনি। ফলে কেনাকাটাও কমছে।
এ ছাড়া ই-কমার্স খাতে ডলার সংকট, পণ্য আমদানিতে বাধা (ঋণপত্র খুলতে না পারা), বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, পণ্যের সংকট থাকা, মানুষের চাহিদা কমে যাওয়া, ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়াও ই-কমার্স খাতে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন তারা। তবে আগামী ঈদে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে বলে আশা তাদের।  জানা গেছে, দেশে ডিজিটাল কমার্সে বছরে বাণিজ্য এখন ৩২ কোটি টাকার বেশি। গ্রাহক আছেন দেড় কোটির মতো।  উদ্যোক্তারা জানান, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরবরাহ খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। যার প্রভাব পণ্যের দাম ও বিক্রির ওপর পড়ছে। বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসে গত এক বছরে প্রায় ২০ শতাংশ লজিস্টিক ব্যয় বেড়েছে। এ ছাড়া নানা কারণে বিক্রি প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। এমনিতেই বেচাবিক্রি কম। এর মধ্যে সব ধরনের খরচই বেড়েছে। এ অবস্থায় পণ্যের দাম বাড়ালে ক্রেতা আরও কমে যাবে। তাই অনলাইন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। তাদের ধারণা ছিল, করোনা পরবর্তীতে এ খাতের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু করোনা শেষ হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপসহ পুরো বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশেও এর ধাক্কা লাগে। এতে গত ৬ মাসে এ খাতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, করোনার প্রকোপ শুরুর পর ডিজিটাল ব্যবসার দ্রুত প্রসার ঘটে। ২০২০ সালের এপ্রিলে ই-কমার্সে লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫৪ কোটি টাকা। মে মাসে তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। এযাবৎকালের মধ্যে ই-কমার্সে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছিল ২০২১ সালের জুনে। ওই মাসে ১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। এরপরই ইভ্যালিসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার অভিযোগ আসতে থাকে। তাতে এ খাতের লেনদেনেও ভাটা পড়ে। তবে ২০২২ সালের দিকে বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে ই-কমার্সে লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩০ কোটি টাকায়।

ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার পণ্য সরবরাহ করা হয়। করোনার আগে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫০ শতাংশ। করোনার সময় নিত্যপণ্যের প্রবৃদ্ধি ৩০০ শতাংশ, খাদ্য সরবরাহ সেবায় প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে সে সময় ই-কমার্সের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। ই-ক্যাব বলছে, করোনার পর ২০২১-২২ সালে প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা আরও বেশি ছিল। কিন্তু গত বছরের শেষদিক থেকে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে প্রবৃদ্ধি কমে ৪০ শতাংশে নেমে আসে। ডলার সংকটের কারণে আমদানিনির্ভর বিভিন্ন পণ্য এখন আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না। সংকট না কাটলে এ প্রবৃদ্ধি আরও কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের এ সংগঠন।

ডেলিভারি উদ্যোক্তা টাইগার জানায়, তার প্রতিষ্ঠান ফেসবুককেন্দ্রিক ই-কমার্স (এফ-কমার্স) প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য ডেলিভারি দিয়ে থাকে। তার প্রতিষ্ঠান এতদিন ডেলিভারি চার্জ বাড়ায়নি। কিন্তু দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও অন্যান্য খরচের সঙ্গে সমন্বয় করতেই ডেলিভারি চার্জ বাড়াতে হচ্ছে। গেজেটস অ্যান্ড লাইফস্টাইলভিত্তিক অনলাইন প্রতিষ্ঠান সেলেক্সট্রা শপের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিব আরাফাত বলেন, আমরা যারা অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে আছি, আমাদের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ডলার রেটের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ফেসবুক মিডিয়া বায়িং অনেক বেড়ে গেছে, যা প্রায় ২৫ শতাংশের মতো। বেড়েছে কর্মীদের খরচ, বেড়েছে পরিবহন খরচও। সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে অনলাইন ব্যবসা কবে থেকে যে মুনাফায় আসবে সেটাই এখন চিন্তার বিষয়।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পিকাবু’র প্রধান নির্বাহী মরিন তালুকদার বলেন, ইভ্যালির দুর্নীতির পর এ খাতে আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু এখনো স্ট্যাবল জায়গায় পৌঁছেনি। গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে ৪০ শতাংশ নিচে বর্তমান বাজারের অবস্থান। তিনি বলেন, মোবাইলের দাম বর্তমান বাজারে ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ফলে বেশি দাম দিয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ নিতে চাইছে না। ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, গ্রাহকের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। বিশেষ করে যারা ফেসবুকনির্ভর (এফ-কমার্স) উদ্যোক্তা, তাদের কারণে ইতিবাচক ফলাফলের হার বাড়ছে না। সেন্ট্রাল ট্র্যাকিং সিস্টেম, সেন্ট্রাল কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। এগুলো চালু করা গেলে এই খাতে আরও স্বচ্ছতা আসবে। গ্রাহকের আস্থা সুদৃঢ় হবে।

দারাজ বাংলাদেশের করপোরেট কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান আহাদুজ্জামান চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব ই-কমার্স খাতে কমবেশি রয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। গত বছরের আগস্ট, সেপ্টেম্বরের পর থেকেই বিশ্ববাজারে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেতে থাকে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর বলেন, ৬ মাস ধরেই অনলাইনে কেনাকাটা কমতির দিকে। ইলেকট্রনিকসহ দামি পণ্য কেনা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া যারা বাইরে থেকে পণ্য আনেন, ডলার সংকট ও দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা আগের মতো পণ্য আনতে পারছেন না। লজিস্টিক সেবারও খরচ বেড়েছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, অন্যান্য দেশও এ ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: