জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধানের বিবৃতি পক্ষপাতদুষ্ট, পূর্বপরিকল্পিত: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
রোববার সরকারের তরফে জারি করা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাল্টা বিবৃতিতে নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্কের বিবৃতিকে পক্ষপাতদুষ্ট ও পূর্বপরিকল্পিত নিন্দা করা হয়।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: সদ্য নির্বাচিত সরকারকে পথ পাল্টে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক বৈশ্বিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান সম্বলিত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের বিবৃতির কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে সরকার। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক গত সোমবার এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই বিবৃতিতে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের ওপর সহিংসতা ও দমন-পীড়ন হওয়াটা পীড়াদায়ক উল্লেখ জাতিসংঘ দূত বলেছিলেন- নির্বাচনকে সামনে রেখে বিগত মাসগুলোতে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা–কর্মীকে নির্বিচার আটক বা ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। এ ধরনের কৌশলগুলো সত্যিকার অর্থে প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য সহায়ক নয়।
রোববার সরকারের তরফে জারি করা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাল্টা বিবৃতিতে নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্কের বিবৃতিকে পক্ষপাতদুষ্ট ও পূর্বপরিকল্পিত নিন্দা করা হয়। বলা হয়, বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা বাদ দিলে ৭ই জানুয়ারির নির্বাচন অভূতপূর্বভাবে শান্তিপূর্ণ ছিল, যা আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের মতামতে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে জেনেভাস্থ ওএইচসিএইচআর দপ্তর প্রচারিত হাই কমিশনার ভলকার তুর্কের বিবৃতিতে সরকারের নজরে এসেছে জানিয়ে সেগুনবাগিচার পাল্টা বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ মনে করে ওএইচসিএইচআর দুর্ভাগ্যবশত তার কার্যপরিধি লঙ্ঘন করেছে।
বিবৃতিতে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা মানবাধিকারকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করার জন্য একপেশে ও পক্ষপাতদুষ্ট মূল্যায়নের পুনরাবৃত্তিমাত্র। এই প্রেক্ষাপটে সরকার সঠিক পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরতে চায়। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি মতে, ৭ই জানুয়ারি জনগণের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক নীতিগুলো সমুন্নত রাখতে সরকারের জোরালো অঙ্গীকার প্রতীয়মান হয়েছে। গুটিকয় ভোটকেন্দ্রে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ছাড়া নির্বাচনের দিনটি অভূতপূর্বভাবে শান্তিপূর্ণ ছিল। মাঠপর্যায়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যুক্ত অনেক আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকের বক্তব্যে এটা উঠে এসেছে। তাই নির্বাচনে সহিংসতা ও বিরোধী প্রার্থীদের দমন-পীড়নের ঘটনা ঘটেছে বলে ওএইচসিএইচআরের দাবি অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট ও পূর্বপরিকল্পিত বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলেও দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অসাংবিধানিক দাবিতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে বিএনপি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করতে সহিংসতা ও নিরপরাধ মানুষ হত্যার পথ বেছে নেয়, যেমনটি দলটি অতীতের জাতীয় নির্বাচনের সময় করেছিল। শুধু গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির কর্মীরা নিরীহ বেসামরিক নাগরিক, কর্তব্যরত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মীসহ ২৪ জনকে হত্যা করেছে। তারা সরকারি-বেসরকারি প্রায় এক হাজার যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়, ট্রেন লাইনচ্যুত করে এবং ট্রেনে হামলা চালিয়ে মা, তাঁর তিন বছরের শিশুসহ যাত্রীদের জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়। বিএনপির ধ্বংসযজ্ঞের পুরো চিত্র ভয়াবহ এবং দেশজুড়ে বিএনপির নৈরাজ্য সময়মতো ও পরে আবারও ওএইচসিএইচআরের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, দেশকে অস্থিতিশীল করা এবং এর গণতান্ত্রিক যাত্রাকে ব্যাহত করার লক্ষ্যে নানা রকম হুমকি, বাধা ও সহিংসতার মধ্যে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা সত্যিই একটি চ্যালেঞ্জ ছিল।
বাংলাদেশ সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এত ব্যাপক সহিংসতা সত্ত্বেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের পদক্ষেপ সংযত, যৌক্তিক ও আইনি কাঠামোর মধ্যে ছিল। নির্বিচার ও গণগ্রেপ্তার, হুমকি, গুমসহ প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নজরদারি ও ব্ল্যাকমেলিংয়ের যে অভিযোগ ওএইচসিএইচআর করেছে, তা ভিত্তিহীন এবং এগুলোর কোনো প্রমাণ নেই। আর গ্রেপ্তারের সংখ্যা নিছক অতিরঞ্জন। শুধু যাঁরা সহিংসতা ও বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত বা উসকানি দিয়েছিলেন, তাঁদেরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আইনের শাসন বজায় রাখতে এবং সব নাগরিকের অধিকার রক্ষার জন্য এসব পদক্ষেপ জরুরি ছিল। অনেক মানবাধিকারকর্মীকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আর কয়েক ডজন গুমের ঘটনার (বেশির ভাগই নভেম্বরে) খবর পাওয়া গেছে বলে ওএইচসিএইচআর যে বক্তব্য দিয়েছে, তা–ও প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে এ অভিযোগও বাস্তবতাবিবর্জিত এবং ওএইচসিএইচআরের পক্ষ থেকে দায়িত্বহীনতার একটি দৃষ্টান্ত। জনসমক্ষে কোনো বিবৃতি দেওয়ার আগে যেকোনো দপ্তরের তথ্যের সত্যতা যাচাই করাটা গুরুত্বপূর্ণ। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সংবিধানের চেতনা এবং মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে একটি প্রগতিশীল সমাজের লক্ষ্যে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট দ্বারা পরিচালিত হবে। বাংলাদেশ গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানায় এবং যেকোনো ন্যায়সংগত উদ্বেগের সমাধান করতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে এর যে ব্যবস্থা রয়েছে, তার সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে উন্মুখ রয়েছে।