গুমে জড়িতদের এখনো দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে: গুম কমিশন

গুমে জড়িতদের এখনো দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে: গুম কমিশন

প্রথম নিউজ, অনলাইন: গুম, খুনের মতো গুরুতর অপরাধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জড়িয়ে পড়লেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের দেওয়া হতো দায়মুক্তি। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে শুধু দায়মুক্তিই নয়, জড়িত কর্মকর্তাদের দেওয়া হতো পুরস্কার। মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা না করে বৃহত্তর ‘অপারেশনাল ম্যান্ডেট’ হিসেবে দেখা হতো, যা বাহিনীগুলোর ভেতরে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ ও ‘সর্বজনীন শৃঙ্খলা’ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হতো। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি গত ১৫ বছর যেমন চলেছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও তা চলমান রয়েছে।

সম্প্রতি গুম সংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিশন সরকারের কাছে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে দায়মুক্তির সংস্কৃতি ছিল এবং এখনো যে আছে, তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কমিশন বলেছে, ‘এমন পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, যেখানে এ ধরনের অপরাধকে নীরব সম্মতি দেওয়া হতো এবং যারা এসব অপরাধ করেছে, তাদের প্রকৃত অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হতো না।’
এখনো দায়মুক্তির সংস্কৃতি চলমান রয়েছে উল্লেখ করে কমিশন বলেছে, ‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা বিশ্বাস করে শুধু সময় পার করলেই হবে; কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তাদের প্রতিষ্ঠানই তাদের রক্ষা করবে। অন্যদিকে, যারা কোনো অপরাধে অভিযুক্ত নন, বরং সাক্ষ্যদাতা হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারেন, তারা ভীত, কারণ তারা মনে করেন যদি তারা এগিয়ে আসেন, তাহলে তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান হয়তো শেষ পর্যন্ত তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, বরং ভবিষ্যতে প্রতিশোধও নিতে পারে।’প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গুম-খুনে জড়িত কর্মকর্তাদের দায়মুক্তির চর্চা ছিল। গুম সংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিশনে একজন জেনারেলের সাক্ষাৎকারে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে আসে। তিনি কমিশনকে জানান, র্যাবে নিয়োজিত কর্মকর্তারা যাতে গুম-খুনের মতো অপরাধে না জড়ায়, সেজন্য র্যাবে পদায়নের আগে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা হতো, আবার দায়িত্ব শেষ করে ফিরে আসার পরও তাদের সঙ্গে পুনরায় আলাপ করা হতো।
এই কর্মকর্তা বলেন, এমন এক ব্রিফিং সেশনে একজন জুনিয়র কর্মকর্তাকে তার ঊর্ধ্বতন জিজ্ঞেস করেন—র্যাবে প্রেষণে থাকাকালে তিনি কাউকে হত্যা করেছেন কি না, করলে কয়জনকে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে, তিনি নিজ হাতে দুজনকে হত্যা করেছেন এবং আরও চারটি হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছেন। এ ধরনের অভিযানের পর নিয়মিতভাবে অর্থ বিতরণ করা হতো। ফলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে আরও জিজ্ঞেস করেন, অভিযানের পর পাওয়া অর্থ দিয়ে তিনি কী করেছেন। উত্তরে ওই কর্মকর্তা বলেন, তিনি সেই টাকা নিজ গ্রামের মসজিদে দান করে দিয়েছেন।
বিচারবহির্ভূত হত্যার একটি ঘটনা কমিশনের কাছে বর্ণনা করেছেন র্যাব ইন্টেলিজেন্সের একটি সেফ হাউসে দায়িত্বে থাকা এক সৈনিক। তিনি কমিশনকে জানান, একটি সেফ হাউস থেকে অল্প সময়ের জন্য এক বন্দি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, কিন্তু দ্রুত তাকে আবার ধরে নিয়ে আসা হয়। ধারণা করা হয়, এর পরপরই ওই বন্দিকে হত্যা করা হয়েছিল। সে সময় আশপাশে থাকা একজন তরুণ অফিসার ভয়ে কাঁপছিলেন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি ওই বন্দি পালিয়ে যেত, তবে প্রতিশোধ হিসেবে তার সিনিয়র অফিসার হয়তো তাকেই মেরে ফেলতেন বা কঠোর শাস্তি দিতেন। ওই সিনিয়র অফিসার বর্বরতার জন্য কুখ্যাত ছিলেন। অনেক কর্মকর্তা কমিশনকে জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতনের নির্দেশ অমান্যের সাহস তাদের ছিল না। একজন কর্মকর্তা বলেন, শুরুতে না করার সাহস ছিল না, এখন আটকে গেছি।
গুম সংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিশন বলেছে, তারা জানতে পেরেছেন কিছু নির্দিষ্ট নিরাপত্তা সংস্থার ভেতরে এখনো কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা না করার অপচেষ্টা চলছে। অভ্যন্তরীণভাবে কিছু গ্রুপ গড়ে উঠেছে, যাদের কাজ কমিশনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সমন্বিত অবস্থান নির্ধারণ করা। এজন্য নিয়মিত ব্রিফিং সেশনের আয়োজন করা হচ্ছে—এমন খবর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাই জানিয়েছেন। কিছু সেশনে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন কেউ কমিশনের সামনে মুখ না খোলে। একজন সাক্ষাৎকারদাতা কমিশনকে জানান, তার ঊর্ধ্বতনরা তাকে বলে দেন নিজের কার্যকলাপ স্বীকার করলেও, অন্য কোনো কর্মকর্তার নাম যেন না বলেন বা কারও কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু না বলেন।
কমিশন বলছে, এমনও দেখা গেছে যে, যেসব কর্মকর্তাকে সাক্ষাৎকারের জন্য কমিশনে ডাকা হয়েছে, তাদের সঙ্গে আইনজীবী পাঠানো হয়েছে। এক সামরিক কর্মকর্তাকে আইনজীবী সঙ্গে নিয়ে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এটি তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নয়, বরং ‘হেডকোয়ার্টার্সের’ নির্দেশ। সবাই যে কমিশনকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অসহযোগিতা করছেন, তা পুরোপুরি সঠিক নয়। র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনী কমিশনকে বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগিতা করেছে।
জবাবদিহির প্রচেষ্টা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সততার বিষয়ে কমিশন বলেছে, অসহযোগিতার এই চলমান পরিবেশ ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির প্রচেষ্টাকে অপূরণীয় ক্ষতির মুখে ফেলছে। পাশাপাশি নিখোঁজদের পরিবারগুলোর ওপরও এটি গভীর মানসিক আঘাত হানে। নিখোঁজদের ভাগ্য সম্পর্কে জানা সম্ভব কেবল তখনই, যখন যারা ভুক্তভোগীদের অপহরণ ও তাদের সর্বশেষ পরিণতির সময় উপস্থিত ছিলেন, তারা সাক্ষ্য দেন। কিন্তু যখন সেই ব্যক্তিদেরই ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়, তখন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো থেকে সত্য উদ্ঘাটনের সম্ভাবনাটিই কেড়ে নেওয়া হয়। আর এই বঞ্চনা যখন ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পালাবদলের পরও অব্যাহত থাকে, তখন তা এক বিশেষভাবে মর্মান্তিক ও অন্যায্য পরিণতিকে নির্দেশ করে। জবাবদিহির প্রতি এই অনীহা নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিভিন্ন শাখার মধ্যেই বিরাজমান।