হঠাৎ বেড়েছে জ্বরের রোগী, আশঙ্কার বিষয় বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে যারা জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্তও রয়েছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং বাকিরা কোভিডসহ সাধারণ জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: ডেঙ্গু সংক্রমণের অনেকগুলো লক্ষণের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে উচ্চমাত্রায় জ্বর। তাই জ্বর হলেই দ্রুত ডেঙ্গু পরীক্ষা করানোর কথা বলছেন চিকিৎসকরা। তবে দেশে এখন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ভাইরাল ফ্লুর মৌসুমও চলছে। ডেঙ্গুর মতো এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীও বাড়ছে। বড়দের পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরাও। অনেকের জ্বরের সঙ্গে রয়েছে সর্দি-কাশি। আর শিশুদের জ্বর ও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ‘ভয়’ ধরাচ্ছে স্বজনদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে যারা জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্তও রয়েছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং বাকিরা কোভিডসহ সাধারণ জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত।
রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় বসবাস করেন একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদকর্মী আজাদুল ইসলাম আদনান। জানা গেছে, তিনি ছাড়া বর্তমানে তার পুরো পরিবারই জ্বরে আক্রান্ত। আদনান বলেন, গত ২৪ জুলাই আমার স্ত্রীর সর্বপ্রথম জ্বর আসে, এরপর আমার দেড় বছরের ছেলেটিও জ্বরে আক্রান্ত হয়। আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম না তাদেরকে নিয়ে কী করবো। বিশেষ করে ছোট বাচ্চাটিকে নিয়ে খুব বেশি ভয়ে ছিলাম। কারণ প্রতি মুহূর্তেই ডেঙ্গুতে বাচ্চাদের মৃত্যুর খবর পাচ্ছিলাম।
তিনি বলেন, আমার স্ত্রী সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর শিশুটি অসুস্থ হলে সামাল দেওয়া যেতো। কিন্তু এক সঙ্গে মা-ছেলে দুজনেই অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় কিছুটা অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। বাচ্চাটা মায়ের বুকের দুধ ছাড়া আর কিছুই খাচ্ছে না। মায়ের কোল থেকে নিচে বা অন্য কারো কাছেও যাচ্ছে না। ডাক্তার দেখিয়ে বাচ্চাকে ওষুধ খাওয়ানোর পরও তার জ্বর কমছে না। তবে স্ত্রী এখন কিছুটা সুস্থ।
রাজধানীর রামপুরা হাজিপাড়া এলাকার ব্যাচেলর বাসায় ভাড়া থাকেন মো. মিজানুর রহমান। গত ২৩ জুলাই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাসায় থেকেই প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাচ্ছিলেন তিনি। জ্বর না কমায় ২৫ জুলাই ডেঙ্গু পরীক্ষা করেন এবং তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। কয়েকদিনের চিকিৎসায় তিনি কিছুটা সুস্থ। তবে তিনি যে ভবনে বাস করেন ওই ভবনের আরও অন্তত ৮ থেকে ১০ জন জ্বরের রোগী আছেন। এর মধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষায় তিন জনের পজিটিভ এসেছে, অন্যরা কেউই ডেঙ্গু পরীক্ষা করেননি।
মিজানুর রহমান বলেন, আমি ভাবতেও পারিনি যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হবো। এতোদিন শুধু আশপাশের অনেককে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার কথা শুনেছি। আমাদের ভবনে যারা জ্বরে আক্রান্ত আছেন, পরীক্ষা করলে হয়তো তাদের অনেকেরই ডেঙ্গু শনাক্ত হতে পারে। তিনি বলেন, আমি ঢাকায় থাকি, আমার পুরো পরিবার থাকে কিশোরগঞ্জ। সেখানেও আমার এক ভাই দুইদিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত। জ্বরটা এখন সব জায়গাতেই ছড়িয়ে গেছে।
সর্দি-জ্বর আর ডেঙ্গু আক্রান্তের এই অবস্থা শুধু আজাদুল ইসলাম আদনান বা মিজানুর রহমানের পরিবারেই নয়। রাজধানী ঢাকার প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই জ্বর-সর্দি আর ডেঙ্গু রোগীর খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করে চিকিৎসা নিচ্ছেন, আবার অধিকাংশই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক এবং বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, আমরা গত কিছুদিন ধরে ব্যাপক হারে জ্বরের রোগী পাচ্ছি। পরীক্ষায় কিছু মানুষের ডেঙ্গু আসছে, আবার কিছু মানুষের ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ভাইরাল ফ্লু আসছে। তবে হঠাৎ করেই এত সংখ্যক জ্বরের রোগী বেড়ে যাওয়াটা অবশ্যই আশঙ্কার বিষয়। হাসপাতালগুলোতে রোগী যদি এভাবেই বাড়তে থাকে, তাহলে সেটি সামাল দেওয়া কষ্টকর হবে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে আমাদের চিকিৎসকরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না। যেখানে একজন চিকিৎসকের ১০ জন রোগী ম্যানেজ করার কথা, সেখানে তাদেরকে বর্তমানে ২০ থেকে ৩০ জন রোগী ম্যানেজ করতে হচ্ছে। ডাক্তার তো এখন চাইলেই রাতারাতি বাড়ানো যাবে না। এ অবস্থায় আমাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো, যেকোনো মূল্যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমানো।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএসএম আলমগীর হোসেন বলেন, এখন শুধু ডেঙ্গুর নয়, ইনফ্লুয়েঞ্জারও সিজন চলছে। বর্তমানে জ্বরের সঙ্গে যাদের সর্দি-কাশি আছে, এরকম প্রায় ৩০ শতাংশেরই ইনফ্লুয়েঞ্জা। জ্বরের সঙ্গে যাদের সর্দি-কাশি আছে, এরকম ৫ থেকে ১০ শতাংশ হলো কোভিড। আর জ্বরের সঙ্গে যাদের শরীর ব্যথা, চোখ ব্যথা আছে এরকম ১০-১২ শতাংশ ডেঙ্গু। সুতরাং জ্বর হলেই যে এখন ডেঙ্গু হবে তা কিন্তু নয়। তবে বর্তমানে ডেঙ্গু হলে যেহেতু মৃত্যু ভয় আছে, এজন্য জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষাটা করিয়ে নেওয়া জরুরি। শুরুতেই যদি ডেঙ্গুটা শনাক্ত হয়ে যায়, তাহলে চিকিৎসা করতেও সহজ হয়। এমনকি জ্বর নিয়ে আতঙ্কটাও কমে যায়, যোগ করেন তিনি।
ড. আলমগীর হোসেন বলেন, ডেঙ্গুর চিকিৎসা জটিল কিছু না, গুরুত্বপূর্ণ হলো সময়মতো হাসপাতালে আসা। জ্বর হলে বিশ্রাম কিংবা চিকিৎসা না নিয়ে অনেকে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। পরীক্ষা করতে চায় না, অবহেলা করে। কিন্তু ডেঙ্গু রোগীর জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি ফ্লুয়েড ম্যানেজমেন্ট। সঠিক সময়ে এটা না হলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাসপাতালের পরিসংখ্যান দিয়ে তো আর বাস্তব চিত্রটা বোঝা যাবে না। কারণ ডেঙ্গু জ্বর হলেও সর্বোচ্চ ১০-১২ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে আসে। অর্থাৎ সামগ্রিক বিবেচনায় দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। অধিকাংশ মানুষের তো জ্বর হয়ে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। সব ডেঙ্গু জ্বর সিভিয়ার হয় না। আর যারা সিভিয়ার কন্ডিশনে চলে যায়, সেখান থেকে তাদের ফিরিয়ে আনাটাও কঠিন হয়ে যায়।
এসব প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গুর পাশাপাশি ভাইরাল ফিভারসহ অবশ্যই অন্যান্য জ্বরও আছে। সব ভাইরাস তো আর ডিটেক্ট করার জন্য মানুষ ল্যাবরেটরিতে গিয়ে পরীক্ষা করে না। কাজেই স্পেসিফিক করে না বলতে পারলেও ভাইরাল ফিভার, সিজনাল ফ্লু, ইনফ্লুয়েঞ্জা-এসব তো এই সিজনে হয়ে থাকে। কারণ ডেঙ্গু হচ্ছে বলে ওগুলো যে বন্ধ হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। এসবের বাইরে কিছুদিন আগে চিকুনগুনিয়াও কিছু পাওয়া গিয়েছিল। এখনো হয়তো পরীক্ষা করলে কিছু পাওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে বাসাবাড়িতে গণহারে জ্বর হচ্ছে এরকম কমপ্লেইন আসে। পাড়া-মহল্লার দোকানের ওষুধ খেয়ে আবার অনেকে ভালো হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারের কাছে এলে, হাসপাতালে এলে হয়তো রোগীদের একটা ডাটাবেজ পাওয়া যায়। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস থেকে কেবল আমরা ততটুকুই পাই, যতটুকু সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে তথ্য আসে। এর বাইরে তো কিছু রোগী স্বাভাবিকভাবে থেকেই যায়।
রোগীতে হাসপাতালগুলো পরিপূর্ণ উল্লেখ করে ডা. নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, প্রতিটি হাসপাতালেই জ্বর-সর্দি আর ডেঙ্গু রোগীতে পরিপূর্ণ। ৫০০ শয্যার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শুধুমাত্র ডেঙ্গু রোগীই আছে ৬০০ জন। তারপরও হাসপাতালগুলো রোগীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে না। এরপরও আমরা হাসপাতালগুলোকে নতুন করে শয্যা প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দিয়েছি। ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঢাকার সব সরকারি হাসপাতালে আরও দেড় হাজার শয্যা বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাহিদ মালেক বলেন, সারা দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে আরও পাঁচ হাজার শয্যা প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। যেখানে শয্যা দেওয়া সম্ভব সেখানেই প্রস্তুত করা হচ্ছে। শুধু মেডিকেল কলেজগুলোতে না, যেখানে শয্যা দেওয়া সম্ভব অর্থাৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী, কুর্মিটোলা, বার্ন ইনস্টিটিউটসহ যেখানে জায়গা আছে, আমরা বলে দিয়েছি শয্যা প্রস্তুত করার জন্য, কিছু শয্যা বাড়ানোর জন্য।
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ৫১ হাজার ৮৩২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ২৯ হাজার ২০০ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ২২ হাজার ৬৩২ জন। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ২৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে।