সার্ভেয়ারের চাকরি নাকি সম্পদ গড়ার পরশ পাথর!

মনির হোসেনের মাসিক বেতন সবমিলিয়ে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা, রাজধানীতে ৭টি ফ্ল্যাট ও ২০ কাঠার বেশি জমির মালিক, অধিকাংশ সম্পদ শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নামে গড়া, ১৫ মে দুদকের মুখোমুখি হয়েছিলেন সার্ভেয়ার মনির

সার্ভেয়ারের চাকরি নাকি সম্পদ গড়ার পরশ পাথর!

প্রথম নিউজ, ঢাকা: ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার, জাতীয় বেতন স্কেলের ১৪তম গ্রেডের কর্মচারী। বেতন সবমিলিয়ে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা। এই বেতনের একজন ব্যক্তি যদি ২০ বছর চাকরি করেন, তারপরও বেতন-বোনাস মিলিয়ে আয় ৭০ লাখ টাকাও হবে না। পারিবারিক ব্যয়ের হিসাবটা না হয় বাদই দেওয়া হলো। অথচ ১৪তম গ্রেডের সরকারি এ কর্মচারীর সম্পদের পরিমাণ শুনলে যে কারও মাথা ঘুরে যাবে। রাজধানীর বহুতল ভবনে সাতটি ফ্ল্যাট, আছে ২০ কাঠার অধিক জমি। সর্বসাকুল্যে মাসিক বেতন ৩০ হাজার টাকা হলে কীভাবে এ সময়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব? হয়তো আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় তিনি এত সম্পদের মালিক বনে গেছেন!

বলছি ঢাকার দোহার উপজেলা ভূমি অফিসে কর্মরত সার্ভেয়ার মনির হোসেনের কথা। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কৃষ্ণপুরে। আগে ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এল এ শাখায় কর্মরত ছিলেন। সেখানে চাকরির তিন বছরের মাথায় দুর্নীতির অভিযোগে তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে বদলি করা হয়। কিন্তু অবৈধ অর্থ ও ক্ষমতার জোরে আবারও ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন তিনি।

মনিরের অবৈধ সম্পদের মধ্যে রয়েছে– গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কৃষ্ণপুরে একতলাবিশিষ্ট আলিশান বাড়ি, রাজধানীর শান্তিবাগ এলাকায় ১০তলা রোজ গার্ডেন ভবনে একাধিক ফ্ল্যাট, ডেমরার হাজি বাদশা মিয়া রোডে গ্রিন কটেজ- ১ ও গ্রিন কটেজ- ২-এ তিনটি ফ্ল্যাট, একই এলাকায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের পাঁচ কাঠার প্লট, সাত কাঠা জমিতে নির্মিত ২০টি দোকান এবং একই এলাকায় গ্রিন কটেজ- ৩ ও গ্রিন কটেজ- ৪ ভবনে একাধিক ফ্ল্যাটের বুকিং রয়েছে বলে জানা গেছে।

অবৈধ সম্পদের মধ্যে আরও রয়েছে– রায়েরবাগে চান্দিনা ভিলেজে জমি, একই এলাকার মিন্টু চত্বরের পাশে সহকর্মী ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সার্ভেয়ার বশির ও তার (মনির) নামে ২০ কাঠা জমি। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত এসব সম্পদ নিজের নাম ছাড়াও স্ত্রী, শ্যালক ও ভায়রা, এমনকি শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নামেও গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানেও তিনি এবং তার আত্মীয়দের নামে কয়েকটি ফ্ল্যাট ও জমি থাকার সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে, দুর্নীতির মামলা থেকে বাঁচতে অধিকাংশ সম্পদ আত্মীয়দের নামে গড়েছেন বলে জানা গেছে।

সার্ভেয়ার মনিরের অঢেল সম্পদের খোঁজে এরই মধ্যে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত ১৫ মে তলব করে সার্ভেয়ার মনিরকে জিজ্ঞাসাবাদও করে সংস্থাটির অনুসন্ধান কর্মকর্তা। যদিও জিজ্ঞাসাবাদে অভিযোগের অধিকাংশ বিষয় তিনি অস্বীকার করেছেন বলে জানা গেছে। একইসঙ্গে অর্জিত সম্পদ নিজের নয় বলে দাবি করেন মনির।

এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনসংযোগ দপ্তরে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। পরে জনসংযোগ দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে ‘অবগত নন’ বলে জানান। অন্যদিকে, সার্ভেয়ার মনিরকে কল করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা  বলেন, মনির হোসেনের সম্পদের খোঁজে কর অফিস, রাজউক, ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রার অফিস, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকসহ অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সব নথিপত্র এখনও হাতে পাওয়া যায়নি। তবে, আমাদের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে অনেক সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘আসলে দুদকের মূল অনুসন্ধান হচ্ছে অভিযোগে থাকা সম্পদের সঙ্গে মনির হোসেনের সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করা। কারণ, অধিকাংশ সম্পদই তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নামে করা। সেগুলো আসলেই মনিরের কি না, সেটা প্রমাণ করা এবং এরপর মনির হোসেনের অর্থের উৎস জানতে চাওয়া। জবাব যথাযথ না হলে মামলার আসামি হবেন তিনি। মনির ছাড়াও ভূমি অফিসের আরও বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রয়েছে’— জানান ওই কর্মকর্তা।

সার্ভেয়ার মনির হোসেন মূলত ঢাকা জেলা প্রশাসকের এল এ শাখায় থেকে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। অবৈধ অর্থের মাধ্যমে তার নিজ নামে ও স্ত্রীর নামে সম্পদ ক্রয় করলেও পরবর্তীতে শ্যালক, ভায়রা ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নামে একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট, মার্কেট ও দোকান এবং ব্যাংকে টাকা রেখেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সম্পদের বর্ণনায় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মনির হোসেন গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কৃষ্ণপুরে একটি একতলাবিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেছেন। রাজধানীর ডেমরার শান্তিবাগ এলাকায় রোজ গার্ডেন নামের ১০তলা ভবনে নিজ নামে একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। এমন একটি ফ্ল্যাটে পরিবারসহ বসবাস করছেন তিনি। ডেমরার হাজি বাদশা মিয়া রোডের ভুট্টো চত্বরের কাছে শর্মা বাড়ির পেছনে গ্রিন কটেজ- ১ নামের ১০তলা ভবনের চতুর্থ ও অষ্টম তলায় সার্ভেয়ার মনিরের স্ত্রী ও ভায়রার নামে ১০৫০ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। বিষয়টি ওই ভবনের একজন নিরাপত্তাকর্মী নিশ্চিত করেছেন।

একই এলাকায় গ্রিন কটেজ- ২ নামের আরও একটি আটতলা ভবনে মনির হোসেনের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। সেখানে দেড় কোটি টাকা মূল্যের তার পাঁচ কাঠার প্লট রয়েছে। প্লটটি তিনি ২০২২ সালের শুরুর দিকে শ্যালকের নামে কেনেন বলে জানা গেছে। ওই জমির পাশেই নিজ মালিকানাধীন সাত কাঠার একটি জমিতে ২০টি দোকান নির্মাণ করেছেন মনির। মার্কেটটি ‘সার্ভেয়ার মনির মার্কেট’ হিসেবে পরিচিত। যার বাজার মূল্য দুই কোটি ২০ লাখ টাকা বলে জানা গেছে। এসব সম্পত্তি তিনি স্ত্রী ও শ্যালকের নামে ক্রয় করেছেন।

একই এলাকায় গ্রিন কটেজ- ৩ নামের ১০তলা একটি ভবন নির্মাণাধীন। যার প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া গ্রিন কটেজ- ৪ ভবনটির পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। ভবন দুটিতে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নামে একাধিক ফ্ল্যাটের বুকিং দিয়েছেন মনির!

মনিরের অর্জিত স্থাবর এসব সম্পদের অংশীজন হিসেবে আছেন সার্ভেয়ার আফান উল্ল্যা ও সার্ভেয়ার বশির (নারায়ণগঞ্জ)। এছাড়া স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড কোনাপাড়া শাখায় একাধিক হিসাবসহ বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে মনিরের অঢেল টাকা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

অন্যান্য অভিযোগ

সার্ভেয়ার মনিরের বিরুদ্ধে অসদুপায়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, তিনি ঢাকা জেলা ডিসি অফিসের এল এ শাখার একটি সংঘবদ্ধ অসাধু চক্রের সঙ্গে জড়িত। এ চক্রের সহায়তায় বিভিন্ন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তির ছত্রছায়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই চক্রের মূলহোতাদের মধ্যে ঢাকা ডিসি অফিসের বেশ কয়েকজন সার্ভেয়ার ও কানুনগোর নাম রয়েছে। জানা যায়, তাদের ডিসি অফিস থেকে বদলি করা যায় না। তারা বিভিন্ন এল এ কেসের কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত টাকায় তারা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি এবং নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন।