সিন্ডিকেটের ‘দখলে’ ডাল-ছোলা
আমদানি বা সরবরাহে ঘাটতি না থাকলেও ভোজ্যতেলের পর এখন ডাল ও ছোলার দাম বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। এজন্য আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষারোপ করছেন একে অপরকে।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: রমজান মাস এলেই বৃদ্ধি পায় ডাল ও ছোলার চাহিদা। কারণ এ দেশের মুসলমানদের ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ ডাল ও ছোলা। এবারও রমজান শুরুর আগেই বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে একশ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাড়িয়ে দিয়েছে এই দুই পণ্যের দাম। আমদানি বা সরবরাহে ঘাটতি না থাকলেও ভোজ্যতেলের পর এখন ডাল ও ছোলার দাম বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। এজন্য আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষারোপ করছেন একে অপরকে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির তথ্যমতে, এক বছরের ব্যবধানে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৪৪ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে ভারতীয় বড় দানার মসুর ডালের কেজি ছিল ৬৫ টাকা। এখন তা কিনতে গুনতে হচ্ছে ১০০ টাকা। আবার মাঝারি দানার (দেশি) মসুর ডালের দাম ছিল ৮০ টাকা। তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৫ টাকা। আর আমদানি করা ছোট দানার মসুর বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা কেজি। যদিও খুচরা বাজারের বাস্তব চিত্রে সরকারি এই হিসাবের চেয়ে খুচরা বাজারে দাম কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি।
টিসিবির হিসাব বলছে, মসুর ডালের সঙ্গে বেড়েছে অ্যাংকর ডালের দামও। ৩৮ থেকে ৪০ টাকার অ্যাংকর এক বছরের ব্যবধানে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। দাম বাড়ায় পিছিয়ে নেই খেসারি ও মুগডালও। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে আমদানি করা ভারতীয় মসুর ডালের কেজি ১০৫ থেকে ১১০ এবং দেশি মসুর ১৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর ছোট দানার মসুরের দাম ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা।
এ ছাড়া মুগ ডালের কেজি ১০০ থেকে ১৫০ এবং অ্যাংকর ডাল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এর মাঝে দোকানভেদে ৫ থেকে ১০ টাকা দামের পার্থক্য রয়েছে। কারওয়ান বাজারে পাইকারিতে বড় দানার মসুর ডাল ৯২, মাঝারি দানা ১১৬ ও ছোট দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১২১ থেকে ১২২ টাকা কেজি। ১০ দিনের ব্যবধানে কেজিতে ৫ টাকার মতো বেড়েছে বলে জানান বিক্রেতারা। পাইকারিতে খেসারির ডাল বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকা কেজি। বাজারে তিন ধরনের মুগডাল পাওয়া যায়। এর মধ্যে ভালো মানের মুগ ডাল পাইকারিতে ১১৪ টাকা কেজি। অন্য মুগ ডালের কেজি ৭২ টাকা। পাইকারিতে এক সপ্তাহে মুগ ডালের দাম কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। আর অ্যাংকর ডালের কেজি ৪৯ থেকে ৫০ টাকা।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, স্থানীয় পর্যায়ে ডালের উৎপাদন কম থাকায় চাহিদার বড় একটি অংশ আমদানি করতে হয়। আবার আর্ন্তজাতিক বাজারেও দাম কিছুটা বেশি। এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে বড় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতারা বলেন, মাসখানেক ধরেই ডালের দাম ধীরে ধীরে বাড়ছে। এখন দাম অনেক বেশি। অনেক দিন ধরে বাজারে ডালের সরবরাহে কিছুটা টান রয়েছে। ডেলিভারি কম, তাই দাম বাড়ছে। তবে এখন বাজারে নতুন ডাল উঠছে। এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে দাম কমে আসবে। তারা জানান, ২৫ কেজির প্রতি বস্তা ভারতীয় মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ২২৮০ থেকে ২৩০০ টাকায়। দেশি ডাল প্রতি বস্তা ২৮৮০ থেকে ২৯০০ টাকা ও ছোট দানার মসুর (আমদানি করা বা ক্যাঙ্গারু ডাল) ৩০০০ থেকে ৩০২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, পৌষ মাসে দেশে বৃষ্টির কারণে ডালের উৎপাদনে কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে। বিশেষ করে বৃষ্টির কারণে ডাল পরিপক্ব হতে দেরি হয়েছে। এতে আমদানির ওপর নির্ভরতা দীর্ঘায়িত হয়েছে। তবে কয়েক দিন ধরেই বাজারে নতুন দেশি ডাল উঠতে শুরু করেছে। ফলে শিগগিরই দাম কমে আসবে।
বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি শফি মাহমুদ বলেন, ডালের দাম পাইকারি বাজারে কমতে শুরু করেছে। দুই সপ্তাহ আগের চেয়ে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা কমেছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আরো কমে যাবে। তবে পাইকারিতে দাম কমলেও অনেক সময় খুচরা বাজারে দাম কমতে দেরি হয়। তার দায় তো পাইকারি বাজারের না। খুচরা ব্যবসায়ীরা একটু বেশি লাভ করে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট ডাল উৎপন্ন হয় ৯ লাখ ৩১ হাজার ২১০ টন। এর মধ্যে খেসারি দুই লাখ ৯৬ হাজার ৯৮১ টন, মসুর দুই লাখ ৫৮ হাজার ৪৬২ টন ও মুগ দুই লাখ ৫২ হাজার ২৬৭ টন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ডাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ লাখ দুই হাজার ৮৭ টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, মসুর, অ্যাংকর, ডাবলি ছোলাসহ সব ধরনের ডাল মিলিয়ে দেশে মোট বার্ষিক চাহিদা ২৬ থেকে ২৭ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে গড়ে উৎপাদন হয় ৯ থেকে ১০ লাখ টন। ফলে প্রতি বছর চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ ডালের ঘাটতি থাকে। এই ঘাটতি পূরণে ১৭ লাখ টনের মতো ডাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ইতোমধ্যে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করেছে। আমদানিকারকদের কারসাজিতে চিনির দাম বেড়েছে। সংকট দেখিয়ে সুপারপাম ও পামওয়েলের দামও বাড়ানো হয়েছে। অবৈধভাবে অধিক মুনাফার আশায় ছোলাসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীচক্র। প্রশাসন এ সিন্ডিকেট ভেঙে না দিলে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। তবে দুদিনে বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ ছোলা কিনে নিয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ছোলার দাম বাড়ানো হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত দামে চট্টগ্রামের কোথাও ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দামে ভোজ্যতেল বিক্রি করছে।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews