শেয়ারবাজার: ১০ বছরে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা তুলেছেন উদ্যোক্তারা

দেশের অর্থনীতির আকার ও নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা বিবেচনায় নিলে শেয়ারবাজার থেকে উদ্যোক্তাদের নেওয়া এই অর্থের পরিমাণ খুবই কম বলছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা।

শেয়ারবাজার: ১০ বছরে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা তুলেছেন উদ্যোক্তারা

প্রথম নিউজ, ঢাকা: শেয়ারবাজার থেকে গত ১০ অর্থবছরে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। ব্যবসা সম্প্রসারণ, ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। দেশের অর্থনীতির আকার ও নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা বিবেচনায় নিলে শেয়ারবাজার থেকে উদ্যোক্তাদের নেওয়া এই অর্থের পরিমাণ খুবই কম বলছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন পাওয়া কোম্পানির সংখ্যা এবং দেশের অর্থনীতির আকার বিবেচনায় নিলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম। এর মূল কারণ হলো উদ্যোক্তারা খুব সহজেই ব্যাংক থেকে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পাচ্ছেন। ফলে ভালো উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজারে আসতে খুব একটা আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ শেয়ারবাজারে এলে জবাবদিহির মধ্যে চলে আসতে হয় এবং অনেক নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়।

তারা আরও বলছেন, উদ্যোক্তাদের একটি অংশ আছে যারা কোম্পানির মালিকানার ভাগ অন্যদের দিতে চান না। আবার কিছু উদ্যোক্তা আছেন ভ্যাট, ট্যাক্স কম দেওয়ার জন্যও পুঁজিবাজারে আসতে চান না। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে প্রণোদনা দিতে হবে ভালো কোম্পানিগুলোকে। একই সঙ্গে নিয়ম-নীতিতে আনতে হবে কিছু পরিবর্তন। তাদের অভিমত, সম্প্রতি যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে এসেছে, এসব কোম্পানির মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবে ভালো কোম্পানি যদি পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী হয়, তাহলে দুর্বল কোম্পানি আসার সংখ্যা কমে যাবে। তখন সার্বিক শেয়ারবাজারেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩৫৬টি। অথচ আরজেএসসির অথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা দুই লাখ ৮৩ হাজার ৩২১টি। এর মধ্যে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির সংখ্যা ৩ হাজার ৬৬টি এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি দুই লাখ ৫ হাজার ৪৮৪টি। এক সময় বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইনে কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার বেশি হলেই পরবর্তী এক বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে ২০১৯ সালে বিএসইসির আইন থেকে এ বিধান বাতিল করা হয়।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পুঁজিবাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির উদ্যোক্তারা ১৫ হাজার ৫৪৭ কোটি ৬৬ লাখ ১৩ হাজার ৮১২ কোটি নিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়েছেন ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে ১৬টি কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ার ছেড়ে ৭ হাজার ৫৫১ কোটি ৫৬ লাখ ৫৪ হাজার ৪০০ টাকা সংগ্রহ করে। গত ১০ বছরের মধ্যে উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজার থেকে সবচেয়ে কম অর্থ নেন ২০১৯-২০ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে মাত্র দুটি কোম্পানি শেয়ার এবং একটি কোম্পানি বন্ডের মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। এই তিন প্রতিষ্ঠানের নেওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৩০৭ কোটি টাকা। দেশের শেয়ারবাজারে এক অর্থবছরে এত কম অর্থ আর উত্তোলন হয়নি।

ওই অর্থবছরে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন কম হওয়ার কারণ ছিল। ২০১৯ সালে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ওঠে খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি একের পর এক দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিচ্ছে। ফলে সার্বিক শেয়ারবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয় কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের আইপিও অনুমোদন নিয়ে। এক পর্যায়ে বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়ে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল কমিশন সভা করে নতুন আইপিও না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি।

ওই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়- সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস ২০১৫ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত ৩০ এপ্রিল থেকে আইপিও সংক্রান্ত নতুন কোনো আবেদন গ্রহণ করা হবে না। অবশ্য ওই সিদ্ধান্তের আড়াই মাসের মধ্যে আইপিওতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটা বাড়িয়ে পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫-এর সংশোধন আনে বিএসইসি। এরপরও দীর্ঘ সময় আইপিও দেওয়া থেকে বিরত থাকে খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। ফলে ২০২০ সালের প্রথম পাঁচ মাসও আইপিও শূন্য থাকে। তবে ২০২০ সালের মে মাসের শেষ দিকে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর আবার আইপিও মার্কেট সরগম হয়ে ওঠে। শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম অর্থবছরেই (২০২০-২১) ১৬টি প্রতিষ্ঠান আইপিওর মাধ্যমে এক হাজার ৬১০ কোটি ৮৭ লাখ ২৩ হাজার ৪৫ টাকা উত্তোলন করে।

এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে আটটি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে ৬৯৯ কোটি ৩৬ লাখ ৯ হাজার ৪০ টাকা সংগ্রহ করে। পাশাপাশি সুকুক’র মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান ৪২৫ কোটি ৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা নেয়। এছাড়া করপোরেট বন্ডের মাধ্যমে চার হাজার ৪৭৩ কোটি ৮০ লাখ ১৩ হাজার ৮০ টাকা সংগ্রহের অনুমোদন পায় ছয় প্রতিষ্ঠান। আর সবশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আইপিওর মাধ্যমে ছয়টি প্রতিষ্ঠান শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজারের  বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৬২১ কোটি ২৬ লাখ ১১ হাজার ৬০ টাকা নিয়েছে। এছাড়া বন্ডের মাধ্যমে তিনটি প্রতিষ্ঠান ৭২৫ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমোদন পায়। অর্থাৎ শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০২২-২৩ অর্থবছরে সবচেয়ে কম আইপিও অনুমোদন দিয়েছে।

এদিকে আইপিও নিয়ে বিতর্ক ওঠার আগে খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩টি কোম্পানি এবং একটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড শেয়ারবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে ৫৭১ কোটি ৬৭ টাকা নেয়। তার আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯টি কোম্পানি ও দুটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড ৫৪১ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছয়টি কোম্পানি ও তিনটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড ৩৯০ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯টি কোম্পানি ও দুটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড ৮৫৮ কোটি ৩০ লাখ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৫টি কোম্পানি ও একটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড এক হাজার ২৪৬ কোটি ৯৭ লাখ ২১ হাজার ২০০ টাকা উত্তোলন করে।

যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে যে পরিমাণ কোম্পানি এসেছে, এ সংখ্যাটা অত্যন্ত নিম্নমানের। জিডিপির তুলনায় আমাদের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন নেপালের তুলনায়ও কম। আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোর অনীহা আছে শেয়ারবাজারে আসার ক্ষেত্রে। কারণ শেয়ারবাজারে এলে জবাবদিহিতা বেড়ে যায়। যাতে ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসে সেজন্য বিএসইসি ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে ভূমিকা পালন করা দরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও শেয়ারবাজারে আনার চেষ্টা করতে হবে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, আমাদের দেশের অর্থনীতির সঙ্গে তুলনা করলে গত ১০ বছরে শেয়ারবাজারে আসা কোম্পানির সংখ্যা বেশ কম। শেয়ারবাজারে এলে কোম্পানির জবাবদিহিতা বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বেশকিছু নিয়ম-কানুন পরিপালন করতে হয়। আবার ব্যাংকে গেলে খুব সহজেই দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পেয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো। সবকিছু মিলেই তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা কম। তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়ার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেশি। প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে দীর্ঘ মেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকে না গিয়ে শেয়ারবাজারে আসে, সে জন্য সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নিয়মনীতি পরিবর্তন করা উচিত। শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানির সংখ্যা বাড়ানো গেলে বাজারে গতিও বেড়ে যাবে। পাশাপাশি অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর বাজারে ভালো কোম্পানির জোগান বাড়লে আইপিও মান নিয়ে যে প্রশ্ন ওঠে তাও দূর হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মো. সায়েদুর রহমান বলেন, আমাদের শেয়ারাবাজারে আসা কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম। এটা আমাদের অর্থনীতির তুলনায়ও কম এবং নিবন্ধিত কোম্পানির তুলনায়ও খুব কম।

তিনি বলেন, আপনি যখন দেখবেন কত লাভ করবেন। কত ট্যাক্স, ভ্যাট ম্যানেজ করতে পারবেন এ বিষয়গুলো যখন দেখেন, তখন তো এত ফর্মালিটিজের মধ্যে আসতে চান না। যে কারণে আমরা প্রতিবার বাজেট প্রস্তাবে বলি তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে কর ব্যবধান বাড়ানোর জন্য। দৃশ্যমান বেনিফিট না থাকলে সে কেন এত ঝামেলার মধ্যে আসবে। যখন ভালো কোম্পানি আসবে না, তখন মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। যদি ১০টি ভালো কোম্পানি আসতো, তাহলে যেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন সেগুলো ঝেড়ে ফেলা যেত। তিনি আরও বলেন, ভারতে জিডিপির তুলনায় মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ৭০-৮০ শতাংশ। হংকংয়ে ১১শ শতাংশ। আমাদের ১২-১৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা অনেক পিছিয়ে। আমাদের যে নীতি-পলিসি আছে, সেগুলো উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করে না। উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার মতো নীতি-পলিসি করা দরকার।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, পুঁজিবাজারে কোম্পানি আনার দায়িত্ব পালন করে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ইস্যু ম্যানেজাররা। কমিশনের কাজ অনুমোদন দেওয়া। ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনার জন্য কমিশন খুবই আন্তরিক। শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানির জোগান বাড়ানোর ক্ষেত্রে যদি কোনো নীতি-পলিসির দরকার হয়, সংশ্লিষ্টরা সে সংক্রান্ত প্রস্তাব দিলে কমিশন খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করবে। তিনি আরও বলেন, ভালো ভালো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে আনার ক্ষেত্রে কমিশন চেষ্টা করছে। পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা যেতে পারে এমন কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকা সরকারের কাছে দেওয়া হয়েছে। কমিশন চেষ্টা করছে পুঁজিবাজারে ভালো ভালো কোম্পানি নিয়ে আসার জন্য।