রপ্তানিমুখী পোশাকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার
প্রথম নিউজ, ঢাকা ঃ নানাবিধ কারণে বাড়তি তৈরি পোশাকের উৎপাদন খরচ। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানিকারকরা দাম না বাড়িয়ে বরং কমিয়েছেন। আলোচনার মাধ্যমে পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা আমার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হবে।’
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি এসএম মান্নান কচি জাগো নিউজকে এসব কথা বলেন। বিশেষ প্রতিনিধি ইব্রাহীম হুসাইন অভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তৈরি পোশাক খাতের নানান বিষয়-আশয়।
এসএম মান্নান কচি: গত পাঁচ বছরে তৈরি পোশাক শিল্পকে নিরাপদ করতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। এসবের পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সেবার দামও বেড়েছে ধাপে ধাপে। ঋণের হার সিঙ্গেল ডিজিট থেকে বেড়ে ১৩-১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাক শিল্পের ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতারা পণ্যের দাম না বাড়িয়ে বরং কিছু ক্ষেত্রে কমিয়েছে। ফলে রপ্তানিকারকরা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাঝারি ও ছোট কারখানার মালিকরা বেঁচে থাকার লড়াই করছেন।
তৈরি পোশাক শিল্পের একজন উদ্যোক্তা ও নেতা হিসেবে আমার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হবে খুচরা বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ডের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পোশাক প্রস্তুতকারকদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ও বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক জায়গায় থাকতে বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্য পাওয়া পোশাকখাতের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
জাগো নিউজ: আপনি কীভাবে ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে সমস্যাটি মোকাবিলা করতে চান?
এসএম মান্নান কচি: তৈরি পোশাক পণ্যের ক্রেতাদের মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা হলো তারা সর্বদা কম দাম প্রস্তাব করে। আবার সব ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে বলে। আমরা নিরাপত্তা মান ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার জন্য তাদের দাবি মেনে চলি। কিন্তু তারা আমাদের পণ্যের মূল্যের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন না।
বাংলাদেশে সফররত ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ (ইউএসটিআর) দলের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে আমাদের ন্যায্যমূল্যের দাবি ব্যক্ত করেছি। তাদের ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে তা তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছি। বিজিএমইএ থেকে আমরা পোশাক সামগ্রীর ন্যায্য ন্যূনতম মূল্য ও সামাজিক নিরীক্ষার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ আচরণবিধি নিশ্চিত করতে মার্কিন সরকারের সমর্থন এবং সহযোগিতা চেয়েছি।
পর্যায়ক্রমে, আমরা বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার ও ক্রেতার প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে দেখা করবো, যেখানে ন্যায্যমূল্যের বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে। অন্যদিকে, আমরা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি তাদের ক্রেতাদের কাছে তুলে ধরার জন্য আহ্বান জানাবো।দাম না বাড়ালে এ খাতের পক্ষে টিকে থাকা খুবই কঠিন হবে। সক্রিয় কারখানার সংখ্যা গত কয়েক বছরে পাঁচ হাজার থেকে ২২শ-এ নেমে এসেছে। এ শিল্প টিকিয়ে রাখা সবার দায়িত্ব। আমি বিশ্বাস করি আমাদের অংশীদাররা এটি বিবেচনা করবে এবং নির্মাতাদের জন্য আরও ভালো দাম দেবে।
জাগো নিউজ: রপ্তানিমুখী এসএমই পোশাক উদ্যোক্তারা অটোমেশন ও যন্ত্রপাতি আপগ্রেডেশন করতে নানা ধরনের প্রতিকূলতার শিকার হচ্ছেন। তাদের সহযোগিতার জন্য আপনার পরিকল্পনা কী?
এসএম মান্নান কচি: বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা বজায় রাখার জন্য অটোমেশন ও যন্ত্রপাতি আপগ্রেডেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অটোমেশন ও প্রযুক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় কোম্পানিগুলো নিজেদের উন্নত করলেও তহবিল স্বল্পতার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়ছেন।
এসএমই উদ্যোক্তারা দেশের ভবিষ্যৎ। তারাই হবে রপ্তানিতে বড় ব্যবসায়ী। সুতরাং, সরকারকে তাদের বেড়ে উঠতে সহায়তা করার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ এবং কর মওকুফের মতো আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি আপগ্রেডেশনের জন্য সরকারকে প্রযুক্তিগত সহায়তাও দিতে হবে। নিরাপত্তা সরঞ্জামের জন্য কর অব্যাহতি এ খাতের জন্য বড় সহায়তা হবে।
জাগো নিউজ: আরএমজি শিল্পের ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করতে আপনি সরকারের কাছ থেকে কী ধরনের সহায়তা চাইবেন?এসএম মান্নান কচি: অবকাঠামোগত দিক থেকে, সরকার বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। যেমন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল। এছাড়াও বিভিন্ন সড়ক চার লেনে উন্নীত করার মাধ্যমে ব্যবসার পরিবেশ সহজ করতে অনেক কিছু করেছে। তবে শুল্ক ও কর বিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তার হয়রানি ব্যবসায়িক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এইচএস কোডের নামে এবং নথি অনুসন্ধানের নামে তারা রপ্তানিকারকদের নানাভাবে হয়রানি করে এবং ঘুস দাবি করে।
আমি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও কাস্টমস সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে দেখা করে অপ্রয়োজনীয় জটিলতা বন্ধ এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাবো। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমাদের ব্যবসার পরিবেশ রপ্তানিকারকদের জন্য সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ করতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে ব্যবসায় গতি আসবে। দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন হবে।
জাগো নিউজ: উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশের পর বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাবে অনেক দেশে। এ প্রভাব মোকাবিলা করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
এসএম মান্নান কচি: ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা অনেক দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার হারাবে। এটি এ খাতটিকে কঠিন প্রতিযোগিতায় ফেলে দেবে। আমরা ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার উপভোগ করবো। তবে উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশের পরও শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখতে এখনই আলোচনা শুরু করতে হবে। সরকারকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে আমাদের বাণিজ্য অংশীদারদের কাছ থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কৌশল তৈরি করতে হবে।
এর বাইরেও সরকার ব্যবসায়ীদের বিকল্পভাবে সহায়তা দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সরকার স্বল্প সুদে ঋণ, তৈরি পোশাক রপ্তানিতকারকদের সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য সেবা দিতে পারে।
জাগো নিউজ: বৈশ্বিক ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য বাংলাদেশের আরএমজি সেক্টরের কী কী শক্তি রয়েছে?এসএম মান্নান কচি: শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করতে নিরাপত্তার মানোন্নয়নে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ব্র্যান্ডের সহযোগিতা, সরকারি সহায়তা এবং উদ্যোগক্তাদের বিপুল বিনিয়োগের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প এখন সবচেয়ে নিরাপদ শিল্প। বাংলাদেশে ২১৫টি গ্রিন সার্টিফায়েড কারখানা রয়েছে, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রতিযোগী দেশের তুলনায় টেকসই। ফলে তৈরি পোশাক আমদানিকারকদের কাছে বাংলাদেশ নির্ভরযোগ্য গন্তব্য। বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে আমাদের এ বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে হবে।