মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ডলার ঘাটতি, নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতি

জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে কাঁচা মরিচসহ সবধরনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েছে।

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ডলার ঘাটতি, নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতি

প্রথম নিউজ, অনলাইন: দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। আর নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির মূলে এখন ডলার। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলার ঘাটতি। ডলারের সংকটের অজুহাত আমদানি করা পণ্যের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে কাঁচা মরিচসহ সবধরনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না; বরং তা বেড়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশের ঘর থেকে বেড়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। এ ছাড়া ডলার সংকটের কারণে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সব খাতেই নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে কমেছে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানি। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। 

গত বছরের মার্চ থেকে ডলারের দামে ঊর্ধ্বগতি, যা এখনো বাড়ছে। এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশ। এতে বেড়ে যাচ্ছে আমদানি খরচ। একইসঙ্গে দেশের বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে পণ্যের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। বাড়ছে পণ্যের দাম।  তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডলার সংকটে গড়ে গত ৪ বছর ধরেই আমদানি কমেছে। সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বহুলাংশে কমিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন ব্যাংকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাবদ যে ডলার আসছে তা দিয়ে আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাচ্ছে না। 

এদিকে বাংলাদেশ চাল আমদানি কম করলেও গম, সয়াবিন তেল এগুলোর প্রায় সবটাই আমদানিনির্ভর। আমদানি-রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার ব্যাংকগুলো দিতে না পারায় এবং অপ্রয়োজনীয় আমদানির ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিনিষেধের কারণে এখন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) বা ঋণপত্র খুলতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন, যা এখনো চলমান। গত এক বছরে এলসি খোলার হার কমেছে ২৭ শতাংশ। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলে ভোগ্যপণ্যের ১৮ শতাংশ, শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালে ৩১ শতাংশ, শিল্পের কাঁচামালের ৩২ শতাংশ, শিল্পের যন্ত্রপাতির ৬০ শতাংশ, বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ৪৬ শতাংশ ও অন্যান্য খাতে এলসি খোলা কমেছে ২০ শতাংশ। গ্যাসের আমদানিও কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়ায় একদিকে আমদানি খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে আমদানির পরিমাণ কমেছে। 

অন্যদিকে, ডলার সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে রেকর্ড ১৩.৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি হয়েছে। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমছে। দেশের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে। 

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এখন আমদানির ক্ষেত্রে ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যমানের ঋণপত্র খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের এলসি খোলা হলে তা আটকেও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার ডলার-স্বল্পতার কারণে অনেক ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণপত্র খোলা বন্ধ রেখেছে বা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ঋণ কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে মূল্যস্ফীতির হার সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি- এই পাঁচ মাস ৮ শতাংশের ঘরে থাকার পর মার্চ থেকে জুন-এই চার মাস ৯ শতাংশের ঘরে উঠেছে। আলোচ্য সময়ে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত দুই খাতেই এ হার বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে বৈশ্বিক অস্থিরতায় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়া, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি এবং দেশের বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। এর প্রভাবে অন্যসব পণ্যেরও দাম বেড়েছে। আমদানি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা গেলে দেশের পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে শিগগিরই সংকট থেকে রেহাই মিলছে না। এ ছাড়া সামনে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। বাজারে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে। তখন মূল্য আরও বাড়বে।

পোশাক শিল্প: ডলার সংকট প্রকট হওয়ায় এ সংকট এখন পোশাক খাতেও দৃশ্যমান হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যেই ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬.৬৭ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে দেশের রপ্তানি পৌঁছায় ৫৫.৫৫ বিলিয়ন ডলারে। কিন্তু ডলার সংকটসহ পশ্চিমা অর্থনীতিগুলোতে মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে রপ্তানি আয় ৫৮ বিলিয়ন ডলারের উচ্চাকাঙ্খী লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪.২৮ শতাংশ কম হয়েছে।

বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ দেশের ব্যবসাকে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অর্থ পরিশোধে বিলম্বসহ নানা কারণে ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খোলা নিয়ে ব্যাংকে সমস্যার মুখে পড়ছেন রপ্তানিকারকরা। এসব সমস্যার মূলে রয়েছে ডলার সংকট। 

প্রসাধনী বাজার: ডলার সংকট আর আমদানি জটিলতায় দেশের প্রসাধনী বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। গত এক বছর ধরে আমদানিকৃত প্রসাধন সামগ্রীর দাম দফায় দফায় বেড়েছে। এলসি (ঋণপত্র) জটিলতায় চাহিদা অনুযায়ী নতুন পণ্য আসছে না। ফলে গত কয়েক মাসে কসমেটিক ও টয়লেট্রিজ সামগ্রীর সরবরাহ কমেছে। আর সরবরাহ কমায় মজুতও কমেছে। এতে দামও বেড়েছে কয়েকগুণ পর্যন্ত। 

বাড়তি দামেই চিনি বিক্রি: দেড় মাস আগে সরকারিভাবে নির্ধারিত খোলা চিনির দাম ছিল কেজিপ্রতি ১১৫ টাকা এবং প্যাকেটজাত ১২৫ টাকা। ৫ই জুন বেসরকারি মিল মালিকরা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। এতে খোলা চিনির দাম ধরা হয় কেজিপ্রতি ১৪০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির ১৫০ টাকা। অথচ ২০২২ সালের জুলাইয়ে চিনি বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৮২ টাকা কেজি দরে।

ওষুধের দাম: ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করতে এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছেন ওষুধ প্রস্তুতকারীরা। ফলে ওষুধ প্রস্তুতকারকদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বাড়তি উৎপাদন খরচের পুরোটা ভোক্তাদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে। 

বিদ্যুৎ উৎপাদন: চাহিদা অনুযায়ী কয়লা আমদানি করতে না পারায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় সংকট দেখা দিয়েছিল। একইসঙ্গে শিল্প ও কৃষি খাতে উৎপাদনে বড় বিপর্যয় নেমে আসে।

আমদানি কম, নিত্যপণ্যের দামে অস্বস্তি: ডলার সংকট আর আমদানি কম দেখিয়ে দেশের বাজারে দফায় দফায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। সাধারণ মানুষকে বেকায়দায় ফেলে বেড়েছে চাল, ভোজ্য তেল, চিনি, ডাল, আটা, ছোলা, পিয়াজ ও কাঁচা মরিচ। এসব পণ্যের দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে ক্রেতাদের ভুগিয়েছে ব্যবসায়ীরা। পরে আমদানি করার পর কিছুটা কমেছিল এসব পণ্যের দাম।

বন্দরে আটকা ৫ লাখ টন চিনি: বন্দরে প্রায় ১ মাস ২০ দিন ধরে ৫ লাখ টন চিনি খালাসের অপেক্ষায় থাকলেও তা ডলার সংকট ও নতুন এলসির অনুমতি না থাকার কারণে খালাস হচ্ছে না। আমদানিকারকেরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বার বার ধর্না দিলেও এর সুরাহা পাচ্ছেন না। এই সংকটের কারণে দেশে আপাতত চিনির দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। 

কর্তৃপক্ষ বলছে, আমদানিকৃত চিনি দ্রুত খালাসের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছে। আলাদা করে চিনি উৎপাদন ও আমাদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলেছে। আমদানিকারকেরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন যে, তাদের দ্রুত চিনি খালাস করার অনুমতি না দেয়া হলে তারা আর চিনি আমদানি করবেন না। এতে দেশের চিনির সংকট আরও ঘনীভূত হবে। 

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, ‘চিনি খালাসের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। দ্রুতই বন্দর থেকে চিনি খালাস হবে।’ তিনি আরও জানান, নতুন এলসির খোলার ব্যাপারেও কী উদ্যোগ নেয়া যায় তা দেখা হচ্ছে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের বিশেষ শাখার প্রটোকল বিভাগের একজন এসপি জানান, কয়েকদিন আগে চিনির বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাসিক মিটিংয়ে উত্থাপিত হয়। কিভাবে দ্রুত ওই চিনি খালাস করা যায় তার জন্য একটি টিম গঠন করা হয়েছে। 

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে যে ৫ লাখ টন চিনি এসেছে তা ব্রাজিল, থাইল্যান্ড ও মেক্সিকো থেকে। এই ৫ লাখ টন চিনি খালাস হলে চিনির বাজারে অস্থিতিশীলতা কমে আসবে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ঋণপত্রের বিল পরিশোধের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় জাহাজ থেকে চিনি খালাস করতে পারছে না।