মাফিয়া সিন্ডিকেটের দ্বন্দ্বের বলি আনার
বলা হচ্ছে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের হোতা এমপি আনারের বন্ধু আকতারুজ্জামান শাহীনের পরিকল্পনায় এই হত্যকাণ্ড সংঘটিত হয়।
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক : দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। নির্বাচিত সংসদ সদস্য বিদেশের মাটিতে নৃশংস কায়দায় খুন হয়েছেন। চোরাচালান সিন্ডিকেটের হাতেই খুন হয়েছেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে এ কারণ সামনে আসলেও এখনো নানা প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। বলা হচ্ছে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের হোতা এমপি আনারের বন্ধু আকতারুজ্জামান শাহীনের পরিকল্পনায় এই হত্যকাণ্ড সংঘটিত হয়। শাহীন এবং এমপি আনার মিলে শ’ শ’ কোটি টাকার স্বর্ণের চোরাচালান পরিচালনা করেছেন বলে তথ্য এসেছে। এই চোরাচালান ব্যবসায় শুধু কী আনার আর শাহীনই ছিলেন? এই প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে। মানবজমিন এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চোরাচালানের সিন্ডিকেট বিস্তৃত। অনেক বড় রাজনৈতিক নেতা এই সিন্ডিকেটে জড়িত। চোরাচালান থেকে আসা বিপুল অর্থের ভাগ পান তারা।
এ কারণে এসব নেতারা নেপথ্যে থেকে পুরো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার নেপথ্যে এই চোরাচালান সিন্ডিকেটের দ্বন্দ্ব বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে। অনেকে বলেছেন, আকতারুজ্জামান এমন পর্যায়ের হোতা নন যে দেশের একজন এমপিকে এভাবে বিদেশে নিয়ে নৃশংস কায়দায় হত্যা করে লাশ গুম করতে পারেন। এই ঘটনার নেপথ্যে আরও শক্তি থাকতে পারে। দেশে থেকে শাহীনকে পরিচালনা করে থাকতে পারেন কেউ। ইতিমধ্যে খুলনা অঞ্চলের একজন নেতা এবং কুষ্টিয়ার একজন এমপি’র নাম সামনে এসেছে। তাদের সঙ্গে এমপি আনারের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। এই নেতারা চোরাচালান সিন্ডিকেটের কাছ থেকে সুবিধা পেতেন কিনা এই প্রশ্নও করছেন কেউ কেউ।
স্থানীয় ও গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান ও মাদক পাচারের সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত। প্রশাসনের কতিপয় লোকও এই চোরাচালান চক্রের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে থাকেন। এই চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে অনেকে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। পরে তারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে এই টাকা খরচ করেন। দলীয় নেতাদের ম্যানেজ করার জন্যও তারা বিপুল অর্থ খরচ করেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে শাহীন ও তার সহযোগীদের নাম এলেও তাদের পেছনেও আরও বড় শক্তি থাকতে পারে। ঘটনার পুরো অনুসন্ধান হলে এর সূত্রও বের হতে পারে।
এ ছাড়া আরেকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এমপি আনারকে কেন এভাবে নৃশংসভাবে খুন করা হলো। এটি কি স্রেফ লাশ গুম বা খুনের আলামত নষ্টের জন্য। নাকি বড় কোনো ক্ষোভ থেকে? এই প্রশ্ন ঝিনাইদহের মানুষের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগেও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগ করার আগে অন্য দলের রাজনীতি করতেন। আওয়ামী লীগে এসে পরপর তিনবার এমপি হয়েছে। তার বিরুদ্ধে এমপি হওয়ার আগে রেড নোটিশ ছিল। অনেক মামলা ছিল। ছিল নানা অভিযোগও। এমন একজন ব্যক্তিকে পরপর তিনবার সংসদ সদস্য হিসেবে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেয়ার পেছনেও কোনো শক্তি জড়িত ছিল কিনা এমন প্রশ্ন রয়েছে জনমনে।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে স্বর্ণের যে চোরাচালান হয় তা ভারতের স্বর্ণের বাজারে বড় ভূমিকা রাখে। এমনকি বাংলাদেশের স্বর্ণের বাজারেও এর প্রভাব রয়েছে। এই চোরাচালানের রুট এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে শুধু স্থানীয় নয়, জাতীয় পর্যায়ের বড় গ্রুপও এরসঙ্গে জড়িত হচ্ছে। এমন অবস্থায় আনার হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে শুধু শাহীন বা তার সহযোগীরা নয় এর সঙ্গে আরও পক্ষ জড়িত থাকতে পারে এমনটা জোর দিয়েই বলছেন অনেকে।
বলা হচ্ছে শাহীন দুই মাস আগে থেকেই এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। হত্যাকান্ডটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় শাহীনের ফুফাতো ভাই খুলনার পূর্ব বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানউল্লাহকে। আমানউল্লাহর পরিকল্পনায় খুনের স্থান কলকাতায় নির্ধারণ করা হয়। এই আমানউল্লাহ এবং শাহীনের স্বজনরা নানাভাবে রাজনীতিতে জড়িত। কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিও হয়েছেন।
এ ছাড়া এমপি আনারকে যে কৌশলে হত্যা করা হয়েছে তা অনেকটা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। অনেকে বলছেন, শাহীন বা তার সহযোগীদের দ্বারা এমন নিখুঁত ঘটনা ঘটানো সম্ভব না। নিশ্চয় আরও বড় কোনো গ্যাং এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে।
উল্লেখ করা যায় যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে স্বর্ণ চোরাচালান উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এখন পর্যন্ত এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে উড়োজাহাজের ক্রু, বিমানবালা, বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্তরের কর্মী থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোর বিভিন্ন স্তরের অনেক মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে। সর্বশেষ দেশে স্বর্ণ চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার ঘটনাকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে ভারতে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। যদিও তার এলাকায় স্বর্ণ চোরাচালানের বিষয়টি অনেকের জানা ছিল না। যে শাহীনের পরিকল্পনায় আনার খুন হয়েছেন তার বিষয়েও এলাকায় খুব একটা চেনাজানা ছিল না।