বেলস পার্ক ছাড়িয়ে এলাকা জুড়ে বরিশালের গণসমাবেশ

বেলস পার্ক ছাড়িয়ে এলাকা জুড়ে বরিশালের গণসমাবেশ

প্রথম নিউজ, বরিশাল: ঘড়ির কাটা বেলা ১১ টা। কানায় কানায় পূর্ণ বরিশাল মহানগরীর বেলস পাক। শুরু হয় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। তখনও শূন্য এলাকা থেকে দুই ট্রলার ভর্তি নেতাকর্মী নৌপথে বরিশালে পৌঁছায়।
সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে বরিশালে সূর্যের তাপও বাড়তে থাকে। এরমধ্যেও নানা রংয়ের ক্যাপ ও গেঞ্জি গায়ে নেতাকর্মীদের মিছিলের স্রোত কানায় কানায় পূর্ণ সমাবেশস্থলের দিকেই। এক পর্যায়ে বেলস পার্ক ছাড়িয়ে গণসমাবেশের আয়তন মহানগরীর কয়েক কিলোমিটারে গিয়ে ঠেকে।   
বিমান পথ ছাড়া ‘ধর্মঘট’র কারণে গত শুক্রবার থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত সড়ক ও নৌপথে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ ছিল। সর্বশেষ ২০১২ সালে ১৯ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে নির্দলীয় তত্ত্ববাধায়ক সরকারের দাবিতে এই বেলা পার্ক বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে সমাবেশ হয়েছিল।
সেই সময়ে যোগ দেওয়া দুই কর্মী বলেন, তখনও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু এভাবে পথে পথে বাধা, হামলা, নৌ ও সড়ক পথ বন্ধ করে বরিশাল মহানগরীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়নি। এই সমাবেশ সম্পর্কে বিএনপি নেতাদের মূল্যায়ন বিএনপির ভাইস চেয়াম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে পথে পথে নেতাকর্মীদের বাধা দেওয়া হয়েছে। সড়ক, নৌপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত ২ নভেম্বর ভোলায় এমভি আওলাদ নামে একটি লঞ্চ লুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে। লুটপাট করা হয়েছে। এরপরও নেতাকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেঘনা, তেঁতুলিয়া নদী পাড়ি দিয়ে তিন দিন আগে বরিশালে এসেছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) শাহজাহান ওমর বীরউত্তম বলেন, এই মাঠে আমি পাকিস্তানের সময় আইয়ুব খানের সমাবেশ দেখিছি, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়ার সমাবেশ দেখেছি। কিন্তু আজকের মতো এতো বড় সমাবেশ আগে দেখিনি।
গত বৃহস্পতিবার লঞ্চ এবং গতশুক্রবার থেকে ছোট-বড় যান চলাচল বন্ধ হওয়ার আগেই বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি এবং বরিশাল জেলার ৪২ উপজেলা থেকে নেতাকর্মীরা বরিশাল সমাবেশে যোগ দেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, গত তিন ধরে যুদ্ধ করে নেতাকর্মীরা সমাবেশকে সফল করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বৃহত্তর বরিশালের নেতাকর্মীরা বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ করে সরকার একটি উপকার করেছে। এখন বিএনপির আন্দোলন সংগ্রাম করতে পরিবহনের প্রয়োজন হবে না। পায় হেঁটে সমাবেশ সফল করবে নেতাকর্মীরা। আমাদের আন্দোলন সরকারের বাধায় বিপ্লবে পরিনত হয়েছে।  

আসার পথে গৌরনদীতে নেতাকর্মীদের গাড়ি ভাঙচুর: গতকাল শনিবার বরিশালের গণসমাবেশে যোগ দিতে আসার পথে নেতাকর্মীদের গাড়িতে গৌরনদীতে হামলা হয়েছে। ৫০-৬০ জনের একটি দল এই হামলা চালায়। গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণের মেয়রপ্রার্থী  ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের গাড়ী বহরে হামলা করা হয়েছে। এসময় তিন গাড়ী ভাঙচুর করা হয়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়। ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন বলেন,' শনিবার ভোর রাতে ঢাকা থেকে তারা বরিশালের উদ্দেশে রওনা দেই। গৌরনদীর মাহিরা বাজারে পৌঁছলে সেখানে তাদের ওপর হামলা হয় ।
তিনি আরো বলেন, আমাদের সমাবেশগুলোতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ সরকারকে ভীত করেছে। জোয়ার আটকাতে না পেরে সমাবেশস্থলে যাওয়ার পথে পথে স্থানীয় আওয়ামীলীগ-যুবলীগ এবং ছাত্রলীগ দিয়ে বাধার সৃষ্টি করছে। রাতের আধারে গাড়িবহরে চোরাগুপ্তা হামলা করে পালিয়ে যাচ্ছে।
 ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন অক্ষত থাকলেও হামলায় আহতরা হলেন, ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির ৩৮ নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক সহিদুল হক সহিদ, ৩৮ নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা মামুন ভূঁইয়া, রকি, ৩৮ নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা কর্মী মোঃ রাসেল, মোঃ বাবুল ও খোকন।  ৪০ নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা, ইমরান ৪২ নং ওয়ার্ড যুবদল সদস্য সচিব মাসুদ রানা,  সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদল নেতা রকি ও আল আমিন প্রমুখ।
এর আগে রাত ২ টার দিকে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলের গাড়ী ভাংচুর করে। তার পরে আল আমিন নামে আরেক জনেরও গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে।  
ফিরত যেতে হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা উলফাতকে
বাধার মুখে ফিরে গেছেন বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা ইশতিয়াক আজিজ উলফাত। তিনি বরিশাল সমাবেশে যোগ দিতে বরিশালের গৌরনদীতে আসলে তাকে বাধা দেওয়া হয়। বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বরিশাল সমাবেশে অংশ নিতে মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত বরিশাল যাবার পথে গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডে প্রায় ৫০-৬০ জন আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ, যুবলীগ তার গাড়ি থামিয়ে হামলার হুমকি গালিগালাজ করে। গাড়ি ভাংচুর করার চেষ্টা করলে ইশতিয়াক আজিজ মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেন। কিন্তু কোনো কাজ না হওয়ায় বাধ্য হয়ে তাকে ফিরে যেতে হয়।
বিএনপি নেতা শাজাহান খান আহত
সমাবেশে যোগ দিতে আসার পথে পটুয়াখালীর গাবুয়া এলাকায় জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান আহবান কমিটির সদস্য শাজাহান খানের মোটরসাইকেল বহরের উপর হামলা করা হয়েছে। এতে তিনিসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। আহত শাজাহান খানের ছেলে জেলা যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শিপলু খান জানান, শুক্রবার সন্ধ্যার পরে শাহজাহান খান বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে বরিশাল যাওয়ার পথে পটুয়াখালী-বরিশাল মহাসড়কের গাবুয়া এলাকায় অতিক্রম কালে ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসীরা তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। হামলায় শাহজাহান খানকে বহনকারী মোটরসাইকেল চালক সাইদুল ও শাজাহান খান নিজে আহত হয়। একই সময়ে হামলায় ইসাহাক ও শাহ আলম নামে অপর দুইজন কর্মী আহত হয়। এ সময় তিনটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়েছে বলে তিনি জানান। এছাড়াও দিনভর ও সন্ধ্যার পরে পটুয়াখালী-বরিশাল মহাসড়কে একাধিক অটো রিক্সা ভাঙচুর করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এই অবস্থায় রাতে নৌপথে ট্রলার, বালকহেটে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী বরিশালে আসে।
হুইল চেয়ারে ছাত্রদলের আকন
বরিশাল জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি সবুজ আকন। কয়েক দিন আগে দলীয় কর্মসূচি শেষে ফেরার পথে মটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হন তিনি। পায়ে ব্যান্ডিজ নিয়ে গতকাল শনিবার বরিশাল বিভাগীয় গণসমাবেশে হুইল চেয়ারে চেপে অন্যদের সাহায্য নিয়ে সমাবেশস্থলে আসেন আকন। গায়ে সাদা কাপড়ে লেখা খালেদা জিয়া মুক্তিপাক এবং পায়ে ব্যান্ডিজের ওপর লেখা শেখ হাসিনা নিপাত যাক। আকন বলেন, মটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পায়ের হাঁড় ফেটে যায়। ঘরে থাকতে পারিনি, দলের টানে চলে এসেছি।
হেঁটে ও ট্রলারে বরিশালে
পটুয়াখালী সদরের শ্রমিক দলের কর্মী খোরশেদ আলম বলেন, বাসে পটুয়াখালী থেকে বরিশালে আসতে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট লাগে। সেখানে আমাকে রিকশা,পায়ে হেঁটে আবার অটোরিকশায় করে বরিশালে এসেছি।
দূরের জেলা বরগুনার বাসিন্দা ও বিএনপির শ্রমবিষয়ক সহ সম্পাদ ফিরোজ উজ জামান বলেন, ধর্মঘটের আগে তাদের চার হাজার নেতাকর্মী এসেছে। আবার শুক্রবার দিবাগত রাত দুই-তিনটার দিকে আরো ৯ হাজার নেতাকর্মী ট্রলার ও বালকহেটে বরিশালে পৌঁছায়।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক জানান, জেলার নদীবেষ্টিত এলাকার নেতাকর্মীরা মধ্যরাতের মধ্যে ট্রলারে বরিশালে পৌঁছান। এছাড়াও মহানগর ও সদর উপজেলাসহ ঝালকাঠী এলাকার কয়েক হাজার নেতাকর্মী দুপুরের মধ্যে সমাবেশ মাঠে পৌঁছান।
ব্যানার বিলবোর্ডে বরিশাল
মাবেশস্থল ঘুরে দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার ক্যাম্প করে যেসব জেলার নেতারা মাঠে খাওয়া, দাওয়া ও ঘুমের ব্যবস্থা করেছিলেন, তা সমাবেশের দিন সকালে গুটিয়ে ফেলা হয়। সমাবেশের চারপাশে মজিবুর রহমান সরোয়ার, জহির উদ্দিন স্বপন, সরফুদ্দিন আহমেদ শান্টু, নুরুল ইসলাম নয়ন, হাফিজ ইব্রাহিম, আবু নাসের মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ, নাজিম উদ্দিন আলম, ইঞ্জিনিয়ার ছোবাহান, নুরুল ইসলাম মনি, আবুল হোসেন, সাইফ মাহমুদ জুয়েল প্রমুখ নেতাদের বড় বড় বিলবোর্ড দেখা যায়। লাল, সবুজ, কমলা, টিয়া,হলুদসহ নানা রংয়ের ক্যাপ ছিল নেতাকর্মীদের মাথায়। গায়ে ছিল গেঞ্জি। এসব নেতাকর্মীদের স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে সমাবেশস্থল।
মাঠের এক পাশে প্রশাসন বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে একটি প্যান্ডেল করে। প্রচন্ত রোদে সমাবেশস্থলে টিকতে না পেরে এই প্যান্ডেল নেতাকর্মীরা আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে। সেখান থেকে তারা নেতাকর্মীদের বক্তব্য শোনেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সরকার আমাদের সমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করতে এই প্যান্ডেল তৈরি করেছিল। কিন্তু এটা আমাদের জন্য আর্শীবাদ হিসেবে কাজ দিয়েছে। এ জন্য ভ্যঙ্গ করে তিনি প্রশাসনকে ধন্যবাদ দেন।
অসুবিধা হলে ফোন দেবেন
বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক সমাবেশ শেষে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, পথে কোনো সমস্যা হলে ফোন দেবেন। আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব। এই সমাবেশ সফল করার জন্য তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানান।