ব্যাংকের ৩০ এমডি’র আমেরিকা সফর নিয়ে সচেতন মহলে নানা প্রশ্ন
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমানও তাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। ডলারের প্রবাহ বাড়াতে প্রবাসীদের মধ্যে অফশোর ব্যাংকিং ফিক্সড ডিপোজিট সংক্রান্ত প্রচারের জন্যই তারা যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: অর্থনীতির অন্যতম সূচক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যখন তলানিতে তখন দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রায় ৩০টি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমানও তাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। ডলারের প্রবাহ বাড়াতে প্রবাসীদের মধ্যে অফশোর ব্যাংকিং ফিক্সড ডিপোজিট সংক্রান্ত প্রচারের জন্যই তারা যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন। প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার পাঠাতে উৎসাহিত করা হবে। ডলার সংকটের মধ্যে একসঙ্গে এত এমডির বিদেশ সফর নিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে উঠেছে নানা প্রশ্ন। এই প্রথমবারের মতো ব্যাংকগুলোর পক্ষে বিদেশে এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এমডিদের একযোগে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়া নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
এদিকে ডলার সংকটের কারণে রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে উদ্বেগ এবং শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলারে (২৩.৭৭ বিলিয়ন)। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ এখন ১ হাজার ৮৩২ কোটি ডলার (১৮.৩২ বিলিয়ন)। তবে প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা কম, যাতে পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে প্রকৃত রিজার্ভের অর্থ দিয়ে তিন মাসেরও আমদানি খরচ মেটানো যাবে না।
ডলার ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া নিয়ে একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টি এর আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন। ওই কর্মসূচি শেষে কয়েকজন এমডি অফশোর ব্যাংকিং’র আওতায় প্রবাসীরা যাতে দেশের ব্যাংকে ডলার জমা করেন, তা নিয়ে প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অফশোর ব্যাংকিং’র আওতায় বাংলাদেশে ডলার আসলে ভালো। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অফশোর ব্যাংকিংয়ে লাভবান হতে হলে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা উন্নয়ন জরুরি।
জানা গেছে, অফশোর ব্যাংকিং হিসাবের আওতায় প্রবাসীরা যাতে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ডলার জমা রাখতে উদ্বুদ্ধ হন, সে জন্য আয়োজিত প্রচারণায় অংশ নেবেন কয়েকজন এমডি। এ ছাড়া অর্থপাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত একটি অনুষ্ঠানে কয়েকজন এমডির যোগ দেয়ার কথা রয়েছে।
সূত্র জানায়, আগামী ২৪শে মে নিউ ইয়র্কে একটি হোটেলে অফশোর ব্যাংকিং বিষয়ে প্রচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানের খরচ বহন করবে ব্যাংকগুলো। যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন। অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত, নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল মোহাম্মদ নাজমুল হুদা। বক্তব্য দেবেন- অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মুরশেদুল কবীর, ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন, ব্যাংক এশিয়ার এমডি সোহেল আর কে হুসেইন, সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন।
একই সময়ে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের আয়োজনে আন্তর্জাতিক ব্যাংক সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হবে। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আরও ২৫ ব্যাংকের এমডি যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন। ব্যাংকগুলোর এমডির বিদেশ যাওয়া-সংক্রান্ত নথি অনুমোদন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক খাতে ডলারের জোগান বাড়াতে বিভিন্ন ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিংকে বিশেষ জোর দিয়েছে। এজন্য নানা প্রচারও চালাচ্ছে ব্যাংক। তারই অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিদের অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় ডলার জমায় উদ্বুদ্ধ করতে দেশটিতে প্রচারমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
প্রবাসীরা বিদেশে যেসব অর্থ আয় করেন সেগুলোর একটি অংশ তারা দেশে পাঠান। আরেকটি অংশ বিভিন্ন ব্যাংকে রেখে খরচ করেন বা সঞ্চয় করেন। বিদেশের ব্যাংকে প্রবাসীরা যেসব অর্থ রাখেন তা দেশীয় ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে জমা রাখলে দেশে ডলারের প্রবাহ বাড়বে।
অন্যদিকে বাড়তি মুনাফার পাশাপাশি যখন খুশি তখনই এসব ডলার তুলে প্রবাসীরা খরচ করতে পারবেন। প্রবাসীরা বিদেশে থেকেই দেশের যেকোনো অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে হিসাব খুলে টাকা জমা রাখতে পারবেন। আবার যখন খুশি তখন তুলেও নিতে পারবেন। দেশের সব ব্যাংকই এখন অনলাইনে লেনদেন করছে। বিদেশে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর শাখা যেমন আছে, তেমনি এক্সচেঞ্জ হাউসও রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিনিধিত্বকারী শাখাও আছে। অফশোর ব্যাংকিং হিসাবের আওতায় প্রবাসীরা যাতে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ডলার জমা রাখতে উদ্বুদ্ধ হন, সেজন্যই ব্যাংকগুলো এই বিশেষ প্রচারের আয়োজন করেছে।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর বড় ট্রেড পার্টনার। তাদের অ্যান্টি মানিলন্ডারিং, টেররিস্ট ফাইনান্সিং, ট্রেড বেজড লন্ডারিং, কেওয়াইসি, নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশের সঙ্গে ব্যবসার কানুন, ইত্যাদি মেনেই আমরা ব্যাংকিং করি। আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের ডাকে আমরা যাচ্ছি। ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের সঙ্গে এমডিদের আলোচনা শেষে ৪টি ব্যাংকের এমডি নিউ ইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিদেশিদের অংশগ্রহণে এক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন, ব্যাংকগুলো যার নাম দিয়েছে আউটরিচ প্রোগ্রাম। নিউ ইয়র্কের ওই অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নরও যোগ দেবেন। তিনি বলেন, যে দুই কাজে এমডিরা যাচ্ছেন, তার দুটোই এই অর্থনীতির বিকাশের জন্য জরুরি। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, তার ইউরোপে একটি সফরের মাধ্যমে অফশোর ব্যাংক ফিক্সড ডিপোজিট ব্যাল্যান্স সিটি ব্যাংকের একাই এখন ২০ মিলিয়ন ডলারের ওপরে। যারা যাচ্ছে সবাই বড় ব্যাংক।
এসব ব্যাংক সরকারকে ২৮ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন ডলার কর দিয়েছে। সেখানে সব এমডির খরচ হবে সোয়া দুই লাখ ডলার বা আড়াই কোটি টাকার বেশি (প্রতি ডলার ১১৬.৪৯ টাকা ধরে)। অনেক ট্রেড পার্টনারের সঙ্গে আমাদের আবার অনেক দ্বিপক্ষীয় মিটিং আছে। এমডিদের কয়েকজন ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন। বাকিরা আজকালের মধ্যে রওনা দেবেন বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম এমডিদের এই সফরের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, যেসব কাজে ওনারা যাচ্ছেন এর কোনোটার জন্যই এমডিদের দল বেঁধে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। সবসময় এমন ভালো কথা শুনি। সব বেড়ানোর আয়োজন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আউটরিচ প্রোগ্রামটা ব্যাংকের নিজস্ব। অফশোর ব্যাংকিং’র জন্য তারা যদি সোর্স অব মবিলাইজিং ফান্ডের কাজ করে তাহলে অসুবিধা কোথায়? কিছু আসলে তো লাভ। রাষ্ট্রই লাভবান হবে। উল্লেখ্য, অফশোর ব্যাংকিং সারা পৃথিবীতে প্রচলিত ব্যাংকিং’র একটি অংশ। বিশ্বজুড়ে অনেক ব্যাংকের জন্য এটা বড় আয়ের অংশ। সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক দেশ এভাবে লাভবান হয়েছে বলে অনেকে বলে থাকেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৯টি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমে যারা বিনিয়োগ করবে তারা বিদেশি বা অনাবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হতে হবে। বিদেশে যে বাংলাদেশি বসবাস করছেন তার পক্ষে দেশে অবস্থানরত কোনো বাংলাদেশি নাগরিক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। পাঁচ ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা- ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চীনা ইউয়ানে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।
ওদিকে গত দুই বছর ধরে প্রায় প্রতি মাসেই রিজার্ভ গড়ে ১ বিলিয়ন ডলার করে কমেছে। সূচকটি নিম্নমুখী হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু ভুল নীতিও ভূমিকা রেখেছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে সামপ্রতিক সময়ে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, সেগুলো রিজার্ভ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে একবার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে হ্যাকাররা। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এখনো ফেরত পাওয়া যায়নি। ২০১৬ সালের রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বর্তমানে মামলা চলছে।
চলমান মামলার মধ্যেই ভারতের একটি অনলাইন প্রত্রিকায় কয়েক বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে ব্যাংক খাত নিয়ে। অনেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সঙ্গে এই খবরের তথ্যের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করছেন। যদিও ওই খবরের সত্যতা নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক বিবৃতিতে বলেছে, নিউ ইয়র্ক ফেডের সঙ্গে লেনদেনে নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে বর্তমানে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নীতি চালু রয়েছে। এর ফলে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তা ভুয়া (ফেক)। দায়সারাগোছের ওই বিবৃতি প্রচার ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে আর কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। এ নিয়ে মুখপাত্র বা গভর্নরও সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করা নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হককে নিয়েও আছে নানা সমালোচনা। ২০১৬ সালের রির্জাভ চুরির ঘটনা প্রকাশ্যে যেন না আসে সে ব্যাপারে এই মেজবাউল হকের দায় ছিল বলে ব্যাংক সংশ্লিষ্ট অনেকে প্রচার করেন।