বন্ধ লাখো তাঁত কারখানা, শ্রমিকদের মানবেতর জীবন
ঘনঘন লোডশেডিং, শ্রমিক ও রং-সুতার মূল্যবৃদ্ধিতে অনেকেই গুটিয়ে নিচ্ছেন এ পেশা। ফলে তাঁতকুঞ্জঘোষিত সিরাজগঞ্জ হারাতে বসেছে ঐতিহ্যের এ শিল্প। বেকার হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক শ্রমিক।
প্রথম নিউজ, সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লিতে আগে ভোরের আলো ফুটতেই তাঁতের খটখট শব্দে মুখর হয়ে উঠতো চারদিক। কিন্তু এখন সেই পল্লি অনেকটাই নীরব-নিস্তব্ধ। ঘনঘন লোডশেডিং, শ্রমিক ও রং-সুতার মূল্যবৃদ্ধিতে অনেকেই গুটিয়ে নিচ্ছেন এ পেশা। ফলে তাঁতকুঞ্জঘোষিত সিরাজগঞ্জ হারাতে বসেছে ঐতিহ্যের এ শিল্প। বেকার হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক শ্রমিক।
সম্প্রতিক তাঁতপল্লি ঘুরে দেখা যায়, ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানামালিকরা জেনারেটরের সাহায্যে কারখানা সচল রাখার চেষ্টা করছেন। তবে ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। এতে শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছা উৎপাদনে অতিরিক্ত টাকা খরচ হচ্ছে তাঁতমালিকদের। এমন পরিস্থিতিতে বেকার হয়ে পড়েছেন তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা শ্রমিকেরা। রোজগার বন্ধ থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা বিপাকে পড়েছেন।
তামাই এলাকার কয়েকজন তাঁতশ্রমিক বলেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মহাজনরা ন্যায্য মূল্যে কাপড় বিক্রি করতে পারছেন না। এ কারণে তাদের কাজ করতে নিষেধ করছেন। আগে একজন শ্রমিক দিন ৭০০-৮০০ টাকার কাজ করতেন। এখন বাধ্য হয়ে ৩০০-৪০০ টাকায় কাজ করছেন। আগে যেখানে ১০ জন শ্রমিক কাজ করতেন, এখন সেখানে তিনজন কাজ করছেন। এ অবস্থায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
বেলকুচি উপজেলার তাঁতমালিক শাহিন প্রামাণিক বলেন, জেলায় প্রায় তিন লাখ তাঁত কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে এক লাখ কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়া এসব কারখানার শ্রমিকের কেউ কেউ অন্য পেশায় গেলেও লক্ষাধিকেরও বেশি শ্রমিক এখনো বেকার রয়েছেন। বর্তমানে আমরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি। তিনি বলেন, ‘দিনের বেলায় তিন ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। এসময় জেনারেটর চালিয়ে কাপড় উৎপাদন করতে গেলে প্রচুর খরচ বেড়ে যায়। সেই খরচ অনুযায়ী বাজারে কাপড় বিক্রি হয় না। এজন্য কারখানা বন্ধ করেছি।’
একই এলাকার লাকী সেভেন কটেজের মালিক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান এ শিল্পের দুর্দিন চলছে। উৎপাদনের তুলনাই কাপড়ের দাম বাড়েনি। এজন্য শ্রমিকদের ঠিকমতো মজুরি দিতে পারছি না। আমাদের ওপর সরকারের নজর নেই। সরকারের কাছে দাবি, তাঁতশিল্পকে বাঁচাতে হলে রং-সুতাসহ সব কাঁচামালের দাম দ্রুত কমাতে হবে। তা নাহলে এ শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব না।’ তামাই এলাকার তাঁতশ্রমিক শহিদুল ইসলাম বলেন, তিনি যে কারখানায় কাজ করতেন, সেখানে ৪০টি পাওয়ার লুম ছিল। যার ৩০টিই বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন শ্রমিকরা। বাকি ১০টিও ঈদের পর বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবে এলাকার তাঁতগুলো বন্ধ হয়ে গেলে তারা কী করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
সাউথ এশিয়া হাইটেক সাটেল ইন্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজার (আমদানি-রপ্তানি) অনিমেষ সরকার বলেন, মজুরি কম হওয়ায় তাঁতশিল্পে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারখানায় ৪০টি তাঁত থাকলেও নিয়মিত কাজ করছেন মাত্র দুজন শ্রমিক। মজুরি কম ও ঠিকভাবে টাকা না পাওয়ায় শ্রমিকরা এ পেশা ছাড়ছেন।
বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ার লুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের জেলা শাখার সভাপতি হাজী বদিউজ্জামান বলেন, তাঁতশিল্পের যেসব কাঁচামাল রয়েছে যেমন রং, সুতা ও তুলা সবকিছুর দাম দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। যে কারণে কাপড় উৎপাদন খরচও বেড়েছে। সম্প্রতিক আরেকটি কারণ ঘনঘন লোডশেডিং। কিছু মালিক জেনারেটর দিয়ে তাঁত চালাতে গিয়ে দেখে ১ লিটার তেলের দাম ১১০ টাকা। জেনারেটর দিয়ে কাপড় উৎপাদন করতে গেলে খরচ বেশি হচ্ছে। ফলে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এমন দুরবস্থা থাকায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে ঢাকা ও দেশের বাইরে চলে গেছেন। এতে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। এসব কিছু মিলে আজ তাঁতশিল্প ধ্বংসের পথে।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বেলকুচি-চৌহালী উপজেলার লিয়াজোঁ কর্মকর্তা তন্বী হোসেন বলেন, তাঁতিদের স্বাবলম্বী করতে আমরা ঋণ দিয়ে থাকি। আগে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার টাকা। এখন আমরা এখন সেই ঋণ বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা করেছি। যাদের কমপক্ষে ১৯টি তাঁত রয়েছে তারা প্রান্তিক তাঁতি হিসেবে এ সুবিধা পাচ্ছেন।