জং ধরছে পদ্মা-মেঘনার নির্মাণাধীন ভবনে, ব্যয় বেড়ে তিনগুণ
প্রথম নিউজ, ঢাকা : অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এগোতে পারছে না দেশের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। অযাচিত হস্তক্ষেপে বিপিসির প্রায় সব প্রকল্পে ধীরগতি। এসব নিয়ে জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক ইকবাল হোসেনের করা ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
দেশের জ্বালানি খাতের সরকারি বিপণনকারী দুই প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণে লেজেগোবরে অবস্থা। নিয়মমাফিক শুরু হওয়ার পর নানান অজুহাতে থমকে যায় পদ্মা অয়েল ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের প্রধান কার্যালয় নির্মাণকাজ। আমলাতান্ত্রিক সময়ক্ষেপণের কারণে ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ-তিনগুণ। এতে পদ্মা অয়েলের ২৩ তলা ভবনের ব্যয় ৬৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৯২ কোটি এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ১৯ তলা ভবনের ব্যয় ৫৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ছাড়িয়েছে ১২০ কোটি টাকা।
২০২০ সালে ভবন দুটি নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা ছিল। নতুন প্রস্তাবনায় পদ্মার ভবনটি ২০২৬ সালে এবং মেঘনার ভবনটি ২০২৭ সালের জুন মাসে শেষ হবে। ভবন দুটি নির্মাণ শেষ হলে এ ব্যয় কততে দাঁড়াবে সেটি এখন দেখার বিষয়।
জানা যায়, ভবন দুটি পদ্মা-মেঘনার হলেও এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেতে হয়। আর এই লালফিতা জটিলতায় বারবার সময়ক্ষেপণের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে। যে কারণে নির্মাণ উপকরণের দাম বৃদ্ধিসহ নানান কারণে কয়েকবছর আগে নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। আবার লোকসানের আশঙ্কা থাকায় চুক্তির নানান ফাঁকফোকরে চলতি কাজ বন্ধ রেখেই পালিয়ে যান ঠিকাদার।
পদ্মা অয়েলের হেড অফিস ভবন নির্মাণে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এখন টেন্ডার প্রক্রিয়ার কাজগুলো চলমান।-পদ্মা অয়েলের ব্যবস্থাপক কপিলুচ ছাত্তার
এ বিষয়ে বিপিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারি কাজগুলো যখন প্রস্তাবনা হয়, ভৌত কাজ শুরু হয় তারও অনেক পরে। সেজন্য প্রস্তাবনা তৈরির সময় বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে তৈরি করতে হয়। পদ্মা-মেঘনার প্রজেক্টগুলো ৯ থেকে ১২ বছর আগে নেওয়া। স্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। বেড়েছে কনসালটেন্সি ব্যয়। একইভাবে স্ট্রাকচারাল কাজের ব্যয়ও বেড়েছে।’
এতে বিগত সময়ের ঠিকাদারেরা কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে গেছেন। তবে প্রস্তাবনা দূরদর্শী হলে কাজগুলো নির্ধারিত সময়ে করা যেত। এখন তো প্রজেক্ট চলমান থাকা অবস্থায় ১০ শতাংশ যোজন-বিয়োজন করা যায়। বেশি খরচের প্রয়োজন হলে তা করা সম্ভব হয় না। ফলে প্রজেক্ট আটকে যায়।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) অনুপম বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিপণন প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার ভবন নির্মাণ প্রকল্পগুলো তারা নিজেরাই বাস্তবায়ন করছে। বিভিন্ন মিটিংয়ে প্রকল্পের অগ্রগতি উপস্থাপন করা হয়। আগ্রাবাদে পদ্মা অয়েল ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ভবন দুটির কাজ পুনরায় শুরুর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
২০১১ সালে পদ্মা অয়েলের প্রধান কার্যালয় নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বিপিসি। প্রথম পর্যায়ে ৬৭ কোটি ৬৬ লাখ ৪৯ হাজার টাকায় ‘কনস্ট্রাকশন অব হেড অফিস বিল্ডিং অব পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড’ নামে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী ওই বছরের ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়।
পরবর্তীসময়ে প্রকল্পটির পরিসর বাড়িয়ে ১০১ কোটি ৯৯ হাজার টাকায় প্রকল্পটি ২০১৭ সালে পুনরায় অনুমোদন দেয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ২৩ তলা ভবনটি (বেজমেন্টসহ) নির্মাণের ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৯২ কোটি ৮১ লাখ টাাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেডকে কার্যাদেশ দেয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি।
চুক্তি অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভবনটি নির্মাণ শেষ করার কথা থাকলেও ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। কাজ বন্ধ হওয়ার আগে ভবনটির মাত্র দুটি বেজমেন্টসহ গ্রাউন্ড ফ্লোরের কিছু অংশের ঢালাই কাজ শেষ হয়।
মেঘনা ১৯ তলা আইকনিক ভবনের অসমাপ্ত নির্মাণকাজ নতুন করে শুরু করা হবে। এজন্য নতুন করে ১২০ কোটি টাকার ডিপিপি (প্রাক্কলন) তৈরি করা হয়েছে। ডিপিপি অনুমোদন হলেই ঠিকাদার নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা হবে।- মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ডিজিএম শফিকুর রহমান তালুকদার
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট পদ্মা অয়েলের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘নানান জটিলতার কারণে ঠিকাদার এমনিতে দেরিতে কাজ শুরু করে। তারপরেও ঠিকাদার নির্মাণকাজ শুরুর পর থেকেই ধীরগতিতে কাজ করছিলেন। একপর্যায়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মহোদয় ভবনটির ডিজাইন পরিবর্তনের পরামর্শ দিলেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঠিকাদার কাজ বন্ধ করে সটকে পড়েন।’
পদ্মা অয়েল সূত্রে জানা যায়, প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশনার পর ভবনটির নতুন করে ড্রয়িং ডিজাইন তৈরির জন্য ৪ কোটি ৭৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় ২০২১ সালের জুন মাসে ‘ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেড’কে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিজাইন ফেজের মূল কাজ শেষ করেছে।
পদ্মা অয়েলের তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯২ কোটি ১০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে ভবন নির্মাণ শেষ করতে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করেছে পদ্মা অয়েল।
প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক কপিলুচ ছাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘পদ্মা অয়েলের হেড অফিস ভবন নির্মাণে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এখন টেন্ডার প্রক্রিয়ার কাজগুলো চলমান।’
তবে কতজন ঠিকাদার টেন্ডারে অংশ নিয়েছেন এবং সবশেষ অগ্রগতির বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি তিনি।
আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় নিজেদের ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৩ সাল থেকে উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রীয় জ্বালানি বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা পেট্রোলিয়াম। ১৯ তলা ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ৫৩ কোটি ৭২ লাখ ৭৮ হাজার টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুমোদন করে মন্ত্রণালয়। উদ্যোগ নিয়েও সময়ক্ষেপণের কারণে ওই টাকায় কাজ না হওয়ায় পরবর্তীসময়ে ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ৬১ কোটি ৭৬ লাখ ৯৪ লাখ টাকার আরেকটি প্রাক্কলন অনুমোদন দেয় মন্ত্রণালয়। এই সময়ের মধ্যে আবাসন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এএনজেড প্রপার্টিজকে ভবন নির্মাণের ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর।
পরের ৪ নভেম্বর তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদমন্ত্রী নসরুল হামিদ আনুষ্ঠানিকভাবে মেঘনা ভবন নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। এরপর কাজ শুরু হলেও ২০২০ সালের ২৬ মার্চ করোনা পরিস্থিতির কারণে ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। কাজ শুরুর পরের ৩২ মাসে মাত্র তিনটি বেজমেন্টসহ দ্বিতীয় তলার কিছু অংশের ভৌত কাঠামো নির্মাণ হয়। এতে প্রকল্পের মাত্র ১৬ শতাংশ কাজ করে ঠিকাদার সটকে পড়েন। ২০২১ সালে এসে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে।
২০২১ সালের শেষের দিকে দ্বিতীয় দফায় ৭৪ কোটি ১০ লাখ টাকার প্রাক্কলন করে টেন্ডার আহ্বান করা হলেও ৮১ কোটি ৩ লাখ টাকায় সর্বনিম্ন দরদাতা পাওয়া যায়। কিন্তু মাত্র ৯ দশমিক ৩৫১ শতাংশ দর বেশি হওয়ার অজুহাতে আবারও টেন্ডার আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয় মেঘনা পেট্রোলিয়াম। এরপর ২০২৩ সালে বুয়েটের মাধ্যমে ভবনের অবশিষ্ট কাজের জন্য ৮৬ কোটি ২ লাখ ৪৯ হাজার টাকার প্রাক্কলন অনুমোদন করে মন্ত্রণালয়। এতেও নতুন ঠিকাদার দর উদ্ধৃত করে ৯০ কোটি ৩ লাখ ১৬ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে ভবন নির্মাণে আগে ব্যয়িত অর্থসহ ১২০ কোটি ৪৪ লাখ ৭২ হাজার টাকায় নতুন প্রাক্কলন প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য গত এপ্রিল মাসে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ডিজিএম (ইঞ্জিনিয়ারিং) শফিকুর রহমান তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেঘনা ১৯ তলা আইকনিক ভবনের অসমাপ্ত নির্মাণকাজ নতুন করে শুরু করা হবে। এজন্য নতুন করে ১২০ কোটি টাকার ডিপিপি (প্রাক্কলন) তৈরি করা হয়েছে। ডিপিপি অনুমোদনের জন্য এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ডিপিপি অনুমোদন হলেই ঠিকাদার নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা হবে।’