ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত উপকূল, ১২ জনের মৃত্যু

পুরোপুরি বিধ্বস্ত ৩৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত সোয়া লাখ ঘরবাড়ি। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৩৭ লাখ মানুষ।

ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত উপকূল, ১২ জনের মৃত্যু

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত উপকূল। জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত গ্রামের পর গ্রাম। পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ। পুরোপুরি বিধ্বস্ত ৩৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত সোয়া লাখ ঘরবাড়ি। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৩৭ লাখ মানুষ। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন ৩ কোটির বেশি মানুষ। মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের। উপড়ে পড়েছে কয়েক লাখ গাছ। বিঘ্নিত হয়েছে ইন্টারনেট ও মুঠোফোন পরিষেবা। সাগর উত্তাল থাকায় জেটিতে ভেড়ানো যায়নি কোনো জাহাজ। ঝড়ের প্রভাবে রাজধানীতে মেট্রোরেল চলাচল বিঘ্নিত হয়েছে কয়েক ঘণ্টা। সারা দেশে বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো হাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জনজীবন।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল গতকাল সকালে দুর্বল হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়। সংস্থাটির সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তিতে পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়।  এ ছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে আজ সকাল পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে এবং সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। গত রোববার সন্ধ্যার পর ঘূর্ণিঝড়টি মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করে। রাত দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১১ কিলোমিটার গতিতে বাতাস বয়ে গেছে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায়। এই ঝড়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে বহু মাছের ঘের। গতকাল বিকালে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান বলেন, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে দেশের উপকূলীয় ৬ জেলায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১৯ জেলার ১০৭টি উপজেলার বাসিন্দারা। এসব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি। এ ছাড়া আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হলো- সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি জেলায় নগদ সহায়তার ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল, ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশুখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, গোখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় সতর্কতার পরিপ্রেক্ষিতে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ৯ হাজার ৪২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্র ও স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৮ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। গরু, মহিষ, ছাগল-ভেড়াসহ আশ্রিত পশুর সংখ্যা ৫২ হাজার ১৪৬। এ ছাড়া দুর্গত মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতে ১ হাজার ৪৭১টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালে অন্তত ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ভোলায় ৩, বরিশালে ৩, পটুয়াখালীতে ২, খুলনা, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় একজন করে মারা গেছেন।

ভোলায় বসতঘরে গাছ পড়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলার লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চরউম্মেদ ইউনিয়নে তীব্র বাতাসে টিনের ঘরে গাছ পড়ে মনেজা (৫৪) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। গাছের ডাল পড়ে জেলার বোরহানউদ্দিনে সাচড়া ৬নং ওয়ার্ডে জাহাঙ্গীর (৫০) নামে আরেকজন ও দৌলতখান পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডে বসতঘরে গাছ পড়ে মাইশা নামের ৪ বছরের এক শিশু নিহত হয়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে শওকত মোড়ল (৬৫) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। গত রোববার সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে। মৃত শওকাত মোড়ল গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামের মৃত নরিম মোড়লের ছেলে। পটুয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।

রোববার দুপুরের পর কলাপাড়ায় ফুফু ও বোনকে নিরাপদ স্থানে আনতে যাওয়ার পথে জোয়ারের পানিতে ডুবে মো. শরীফ (২৭) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। ধূলাসর ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বাউফলে ঘরের নিচে চাপা পড়ে করিম খান (৬২) নিহত হয়েছেন। বরিশালে রেমালের প্রভাবে রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন একটি বিল্ডিংয়ের ৩য় তলার দেয়াল ধসে লোকমান হোটেলের মালিকসহ ২ জন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- লোকমান (৫৫) ও মোকলেস (২৫)। এ ছাড়া জালাল সিকদার নামের আরও একজন নিহত হয়েছেন। কুমিল্লা নগরীতে নির্মাণাধীন একটি ভবনের দেয়াল ধসে সাইফুল ইসলাম সাগর (১২) নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টার দিকে নগরীর শাকতলা এলাকায় নূর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এ ঘটনা ঘটে। নিহত স্কুলছাত্র সাইফুল ইসলাম সাগর ওই প্রতিষ্ঠানের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিল। সে শাকতলা এলাকার অলী আহমেদের ছেলে।

চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে এক যুবক মারা গেছেন। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বায়েজিদের চন্দ্রনগর কলাবাগান এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত যুবকের নাম সাইফুল ইসলাম হৃদয় (২৬)। তিনি নির্মাণাধীন ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ধসে পড়া দেয়ালে চাপা পড়েন। খুলনায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে তীব্র বাতাস ও বৃষ্টিতে ঘরের উপর গাছ উপড়ে পড়ে লালচাঁদ মোড়ল (৩৬) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। রাতে উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের গাওঘরা গরিয়ালডাঙ্গা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। লালচাঁদ মোড়ল গরিয়ালডাঙ্গা গ্রামের গহর মোড়লের ছেলে। তিনি কৃষিকাজ করতেন। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৩ কোটি গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এসব গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখে সংস্থাগুলো। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) পরিচালক (কারিগরি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দুর্ঘটনা এড়াতে গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ১ কোটি ৫৫ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ঝড়ের তাণ্ডব কমে যাওয়ার পর দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করে দিতে আমাদের কর্মীরা প্রস্তুত রয়েছেন।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন উপকূলে মুঠোফোন সেবা বিঘ্নিত। অপারেটরদের টাওয়ারগুলোতে বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটর দিয়ে সেবা দেয়ার চেষ্টা হলেও নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা দেয়া যায়নি। এতে প্রায় ১২ হাজারের বেশি টাওয়ার থেকে নেটওয়ার্ক ব্যাহত হচ্ছে বলে অপারেটরগুলো জানিয়েছে। মোবাইল অপারেটর সূত্রে জানা যায়, গতকাল দুপুর ৩টা পর্যন্ত উপকূলীয় ৯টি জেলার ১২ হাজারের বেশি মোবাইল টাওয়ার থেকে নেটওয়ার্ক ব্যাহত হয়েছে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এ সংখ্যা আরও বাড়তে থাকবে। অপারেটররা জানায়, বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটর দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় নেটওয়ার্ক সচল রাখা হয়। কিন্তু জেনারেটর ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত চলতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর নির্ভর করছে মোবাইল নেটওয়ার্ক স্বাভাবিক হওয়ার বিষয়। উপকূলীয় অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রায় ৩ লাখ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) গ্রাহক ফিক্সড্‌ ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।

একইসঙ্গে প্রচণ্ড ঝড়ে ক্যাবলের ক্ষয়ক্ষতির কারণে ১০০টিরও বেশি আইএসপি অপারেটরের নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ইমারজেন্সি রেসপন্স টিমের রিপোর্টে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। বিটিআরসি মহাপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপরারেশন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মুস্তাফিজুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সকাল ১০টা পর্যন্ত হালনাগাদ করা ওই সেলের আইএসপি অপারেটরদের স্ট্যাটাস রিপোর্ট বলছে- উপকূলীয় এলাকাগুলোতে গাছপালা ভেঙে পড়া, বিদ্যুৎ না থাকা এবং ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ইন্টারনেট ক্যাবলের ক্ষয়ক্ষতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর ১০০ এর অধিক আইএসপি অপারেটরের নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম পুরোপুরি সচল করা যায়নি। বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদীতে প্রচণ্ড ঢেউয়ের কারণে সকালের জোয়ারে সাগর থেকে গতকাল একটি জাহাজও জেটিতে ভেড়ানো যায়নি।

তবে পণ্য খালাস কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল। সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে বন্দরের জেটি থেকে ১৯টি জাহাজ সাগরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাতে বন্দর জেটি ফাঁকা হয়ে যায়। রেমালের প্রভাবে গতকাল সকাল ৭টার কিছুক্ষণ পরে রাজধানীতে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় স্টেশনগুলো থেকে মাইকিং করে জানানো হয় চলাচলে সাময়িক বিলম্ব হবে। দুই ঘণ্টা বিলম্ব করে সকাল ৮টা ৫৪ মিনিটে মেট্রো চলাচল স্বাভাবিক হয়। মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানায়, ইলেকট্রিক পাওয়ার সাপ্লাই ফল করার কারণে টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দিলে মেট্রো চলাচল বন্ধ রাখা হয়। শেওড়াপাড়া থেকে বিজয় সরণি অংশে এই সমস্যা দেখা দেয়। এমন অবস্থায় অফিসগামী মানুষ বিপদের মুখে পড়েন। দিনব্যাপী থেমে থেমে চলে মেট্রোরেল।